উদ্যোক্তা কি এবং কেন? উদ্যোক্তা হতে হলে কি কি প্রয়োজন

অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য নতুন নতুন উদ্যোগ নেওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। উদ্যোক্তা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারনে আমরা প্রায় সময় এই কনসেপ্ট সম্পর্কে তেমন ধারণা রাখি না। আমাদের আজকের লেখায় উদ্যোক্তা কি এবং উদ্যোক্তা হতে হলে কি কি প্রয়োজন সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

উদ্যোক্তা কি? 

যে কোন ইনোভেশন বা টেকনোলজিকে পণ্য বা সেবায় পরিণত করে তাকে উদ্যোক্তা বলে। গতানুগতিক বিজনেস থেকে এর প্রধান পার্থক্য হচ্ছে উদ্যোক্তা নতুন যে পণ্য তৈরি করে তা মার্কেটে অ্যাভেইলেবল না। অর্থাৎ উক্ত প্রোডাক্ট সম্পর্কে কেউ এখনো জানে না এবং এর নাম কেউ শোনেনি। সহজ করে বলতে গেলে যখন কেউ নিজে কর্মসংস্থান তৈরি করতে কারো অধীন হয়ে চাকরি না করে নিজে নিজে কিছু করার চেষ্টা করে তখন তাকে উদ্যোক্তা বলে। 

উদ্যোক্তা কি

আমাদের দেশ তথা বিশ্ব ব্যাপী এই প্রবণতা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন অনেকেই লেখাপড়া শেষ করে অথবা লেখাপড়া চলাকালীন বিভিন্ন রকম উদ্যোগের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে। এতে স্টাডি শেষ করেই অনেকেই সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে কারণে উদ্যোক্তা হওয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে- 

  • সামাজিক ভাবে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করা যায়। যেমন বিভিন্ন ছোট ছোট উদ্যোগ নিয়ে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব। এতে নিজের উন্নতির পাশাপাশি আশপাশের মানুষ দের নিয়ে সামাজিক উন্নয়ন করা সম্ভব। 
  • উদ্যোক্তারা স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারে। পাশাপাশি সকল প্রকার কার্যক্রমের মধ্যে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করে। যে কারণে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্যে থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। 
  • অর্থনৈতিক উন্নয়ন হওয়ার পথে উদ্যোক্তা অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার কারণে দেশের অর্থনৈতিক দিক উন্নত হয়। পাশাপাশি নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করা সম্ভব হয়। যে কারণে তরুণ সমাজের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা সব থেকে বেশি দেখা যায়। 
  • উদ্যোক্তা হলে নিজের সৃজনশীলতা প্রকাশ করার স্বাধীনতা পাওয়া যায়। আপনি কখনোই অন্য কারো আন্ডারে চাকরি করে নিজের সৃজনশীলতা তেমন ভাবে প্রকাশ করতে পারবেন না। কিন্তু নিজে উদ্যোক্তা হয়ে নতুন নতুন প্রোজেক্টের মাধ্যমে উদ্ভাবন করতে পারবেন। 

উদ্যোক্তা হতে হলে কি কি প্রয়োজন?

উদ্যোক্তা হলে হলে যে যে গুণ থাকতে হবে তা নিচে বর্ণনা করা হলো। 

লিডারশিপ দক্ষতা

উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আপনাকে সবার আগে একজন লিডার হতে হবে। কারণ আপনি যখন কোন উদ্যোগ সফল করতে চাইবেন তখন আপনার একটি শক্তিশালী টিম প্রয়োজন পরবে। এই টিম আপনার মিশন ও ভিশনকে বাস্তবে রূপ দেবে। কিন্তু আপনি যদি তাদের সঠিকভাবে গাইড করতে না পারেন তাহলে আপনার পরিশ্রম বৃথা যাবে। 

এই কারণে একজন সফল উদ্যোক্তার মধ্যে লিডারশিপ গুনাবলি থাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে আপনার মধ্যে লিডারের গুনাবলি না থাকলে আপনার টিমকে সঠিক পথে গাইড করতে পারবেন না। যে কারণে তারা উদ্যোগ সফল করার জন্য সঠিক পথ পাবে না। এতে আপনার সময় ও পরিশ্রম দুটোই নষ্ট হবে। 

সৃজনশীলতা

উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য সৃজনশীলতা অনেক প্রয়োজনীয়। কারণ সৃজনশীল চিন্তা থেকেই কিন্তু একজনের মনে নতুন কোন উদ্যোগ নেওয়ার চাহিদা তৈরি হয়ে থাকে। পাশাপাশি একজন উদ্যোক্তার নিত্যনতুন ধারণা তৈরি করে তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্যাপাবিলিটি থাকতে হবে। না হলে কম্পিটিশনে যেমন টিকে থাকা সম্ভব হবে না তেমনি উদ্যোগ সামনের দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। 

ঝুঁকি নেওয়ার সাহসিকতা

সফলতার আরেক নাম হচ্ছে ঝুঁকি নেওয়া। আপনি যদি আপনার কমফোর্ট জোন থেকে বের হয়ে চিন্তা করতে না পারেন তাহলে একটি নির্দিষ্ট ম্যাট্রিক্সের মধ্যেই আটকে থাকবেন। এই ম্যাট্রিক্স থেকে বের হতে চাইলে সর্বপ্রথম ঝুঁকি নিতে হবে। বিশেষ করে একজন উদ্যোক্তার ঝুঁকি নেওয়ার মন মানসিকতা থাকতে হবে। না হলে তার দ্বারা নতুন কোন উদ্ভাবন করা যেমন সম্ভব না তেমনি তার কোন উদ্যোগ আলোর মুখ দেখবে না। 

আর্থিক সচ্ছলতা

উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য ন্যূনতম অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। যদিও কিছু কিছু উদ্যোগে কোন ধরনের পুঁজি ছাড়াই শুরু করা যায়। তবে নিজেকে একজন প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তা হিসেবে প্রকাশ করতে চাইলে অবশ্যই আর্থিক দিক দিয়ে স্বাবলম্বী হতে হবে। কারণ কোন উদ্যোগ সফল করার জন্য তার পেছনে যেমন লোকবল প্রয়োজন তেমনি মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। পাশাপাশি উদ্যোক্তা জার্নি সামনের দিকে এগিয়ে নিতে ধাপে ধাপে অর্থ খরচ করতে হবে। না হলে অর্ধেক পথে গিয়ে প্রোজেক্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

উদ্যোক্তা মন-মানুষিকতা

উদ্যোক্তা মন-মানুষিকতা একজন সাধারণ মানুষকে সফল উদ্যোক্তায় পরিণত করে। কারণ উদ্যোক্তা মন মানসিকতা থাকলে বিজনেসে বিভিন্ন রকম ঝুঁকি নেওয়ার সাহস তৈরি হয়। প্রতিটি বিজনেসে অনেকরকম চড়াই উতরাই থাকে। একজন উদ্যোক্তার যদি এই ধরনের মানসিকতা না থাকে তাহলে সে কখনোই বিপদে ধৈর্য ধরতে পারবে না। পাশাপাশি সে কোন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে পারবে না। যে কারণে বিজনেসে শুরুতে লস হওয়া শুরু করলে হাল ছেড়ে দিবে এবং নতুন কিছু করার চেষ্টা করবে। যা একজন উদ্যোক্তার জন্য অনেক ক্ষতিকর। 

বিজনেসের অভিজ্ঞতা

একজন উদ্যোক্তার মধ্যে বিজনেস কীভাবে কাজ করে এবং এর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। কারণ বিজনেস চলার পথে যত ধরনের ঝামেলা আসবে তা তাকে শক্ত হাতে মোকাবেলা করতে হবে। অন্যদিকে বিজনেসে অভিজ্ঞতা না থাকলে তার নেওয়া উদ্যোগ বাস্তবসম্মত হবে না। যে কারণে একজন উদ্যোক্তার মধ্যে বিজনেসের বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। 

মার্কেটিং জ্ঞান

উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য অন্যান্য গুণ থাকার পাশাপাশি মার্কেটিং গুণ থাকতে হবে। কারণ একটি উদ্যোগ নেওয়ার পর তা যদি কাঙ্ক্ষিত মানুষের মধ্যে পৌঁছানো না যায় তাহলে কিন্তু উদ্যোগ নেওয়ার কোন সার্থকতা থাকে না। একজন উদ্যোক্তার গতানুগতিক মার্কেটিং পদ্ধতি জানার পাশাপাশি ডিজিটাল মার্কেটিং সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকতে হবে। এতে প্রোডাক্ট সেল যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি রেভিনিউ বাড়ানো সম্ভব হবে।

উদ্যোক্তা কত প্রকার

উদ্যোক্তা কত প্রকার কি কি?

সাধারণত অনেক ধরনের উদ্যোক্তা হয়ে থাকে। এখানে সব থেকে বেশি প্রচলিত উদ্যোক্তা প্রকারভেদ গুলো আলোচনা করা হলো। 

ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা

ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা হচ্ছে তারা যারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগ নিয়ে থাকেন। এই ধরনের উদ্যোগের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে মুনাফা উপার্জন করা। অর্থাৎ এই ধরনের উদ্যোক্তা পণ্য বা সেবা বিক্রি করার মাধ্যমে আয় করে থাকে। প্রান্তিক পর্যায় কর্মসংস্থান তৈরিতে এই ধরনের উদ্যোগ অনেক কার্যকরী। 

সামাজিক উদ্যোক্তা

এই ধরনের উদ্যোক্তা হচ্ছে তারা যারা বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিরসনে কাজ করে থাকে। অর্থাৎ তারা সামাজিক সমস্যা নিয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় দারিদ্র বিমোচন ও শিক্ষার প্রসার করা। এখানে মুনাফা অর্জনকে গৌণ হিসেবে ধরে আর্থসামাজিক জীবন উন্নত করার দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। 

প্রযুক্তিগত উদ্যোক্তা

বর্তমান সময়ে এই ধরনের উদ্যোক্তা সব থেকে বেশি দেখা যায়। কারণ টেকনোলজি রেভুলেশন হওয়ার কারণে ব্যক্তি পর্যায়ে প্রযুক্তি উদ্যোক্তার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা বিভিন্ন সেমিনার বা পত্র-পত্রিকায় স্টার্ট-আপ শব্দটি শুনে থাকি। এটি মূলত প্রযুক্তিগত উদ্যোক্তাদের দ্বারা তৈরি। 

প্রযুক্তিগত উদ্যোক্তাদের কাজ হচ্ছে নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করে তা মানুষের জীবনের সাথে কানেক্ট করে দেওয়া। অর্থাৎ প্রযুক্তি আপডেট হওয়ার সাথে নতুন নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়। যা মানুষের জীবনে পজিটিভ প্রভাব ফেলার কাজ করে থাকে প্রযুক্তি উদ্যোক্তা। 

কৃষি উদ্যোক্তা

কৃষি আমাদের জীবন বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাজ করে। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়া আমাদের জীবন এমনভাবে পরিবর্তন করে দিয়েছে যে আমরা কৃষি থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। তবে বর্তমান সময়ে অনেক নতুন নতুন উদ্যোক্তা কৃষি ক্ষেত্রে তাদের উদ্ভাবন শুরু করেছে। মূলত যারা কৃষির উন্নয়নে ছোট বড় উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে তাদের কৃষি উদ্যোক্তা বলা হয়ে থাকে। 

ইন্ট্রাপ্রেনিয়ার 

যখন কেউ কোন প্রতিষ্ঠানের ভেতরে থেকে নতুন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে তাকে ইন্ট্রাপ্রেনিয়ার বলে। এই ধরনের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে থাকলেও তাদের নতুন নতুন উদ্ভাবন করার সুযোগ থাকে। 

শেষ কথা

আমাদের উদ্যোক্তা হওয়ার লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য প্রায় একই থাকে। নতুন নতুন উদ্যোগ নেওয়া হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়। এই লেখায় উদ্যোক্তা কি এবং উদ্যোক্তা হতে হলে কি কি প্রয়োজন সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।