বাংলাদেশে উদ্যোক্তা হওয়ার পথে বাধা গুলো কী?

বর্তমান সময় হচ্ছে উদ্যোক্তা নির্ভর অর্থনীতির। ছোট থেকে মাঝারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ দেশ ও সমাজকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক প্রচারণার কারণে যুবক যুবতীদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হচ্ছে। তবে পারিপার্শ্বিক অনেক কারণে উদ্যোক্তা হওয়ার এই জার্নিতে অনেকেই পিছপা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের আজকের লেখায় উদ্যোক্তা হওয়ার পথে বাধা গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

উদ্যোক্তা মানসিকতা না থাকা

উদ্যোক্তা হচ্ছে একটি দায়িত্বশীল কার্যক্রম। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা সবাই লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করার জন্য ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন দেখে আসি। যে কারণে আমরা চাকরি করা ছাড়া মুক্ত ভাবে অন্য কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করতে পারি না। এতে আমাদের মধ্যে দাসত্ব মনোভাব অনেক জোরালোভাবে দেখা দেয়।

অন্যদিকে উদ্যোক্তা হতে গেলে সবার প্রথম নিজের ভেতর থেকে এই দাসত্ব ভাব মুছে ফেলতে হয়। পাশাপাশি স্যাক্রিফাইস করার জন্য সমসময় রেডি থাকতে হয়। কিন্তু নিজের কমফোর্ট জোন থেকে আমরা কেউ বেড়িয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা করি না। কিন্তু একজন উদ্যোক্তা হতে গেলে সবার প্রথমে নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বেড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। 

যা আমাদের অনেকের জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশে কম পরিমাণে উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার পেছনে এটি সব থেকে বড় কারণ। তবে বর্তমানে প্রেক্ষাপট অনেক পাল্টে গেছে। অনেক তরুণ তাদের স্টাবল লাইফ থেকে বেড়িয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শুরু করছে। এতে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ার পাশাপাশি সবার মাঝে অনুপ্রেরণা বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

উদ্যোক্তা মানসিকতা না থাকা

অভিজ্ঞতা না থাকা

উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে। যে কোন সেক্টরে কোন নতুন উদ্যোগ নেওয়ার পূর্বে সে বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে সেখানে কখনোই সফলতা পাওয়া সম্ভব হয় না। যাইহোক, তরুণদের মধ্যে একটি মানসিকতা কাজ করে যে উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হগতে চাইলে উক্ত বিষয়ে ডিগ্রি থাকলেই হবে। অর্থাৎ যে বিষয়ে উদ্যোক্তা হবে সে বিষয়ে পুথিগত বিদ্যা এনাফ। কিন্তু বাস্তবতা আসলে ভিন্ন। 

বাস্তব জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা না থাকলে যে কোন ধরনের উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখবে না। কারণ হচ্ছে বিজনেস একটি গতানুগতিক ধারা। এখানে একদিন সেল বেশি করলেই যে সফল তা নয়। বরং অনেক লম্বা সময় ধরে মার্কেটে টিকে থাকাই হচ্ছে সফলতা। সেই দিক দিয়ে একজন ডিগ্রিধারী উদ্যোক্তার থেকে একজন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন উদ্যোক্তা বেশি সময় মার্কেটে টিকে থাকতে পারবে। কারণ সে জানে কীভাবে সেল করতে হয় এবং বিজনেস টিকিয়ে রাখতে হয়। 

অর্থের অভাব

আমাদের দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শুরু করে যাবতীয় লোন ব্যবস্থা শুধু রাঘব বোয়ালদের জন্য কাজ করে। ক্ষুদ্র বা মাঝারি কোন উদ্যোক্তা যদি ঋণ নিতে চায় তাহলে তাকে অনেক ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তারপরেও অনেকে ঋণ পায় না। যে কারণে আপনার আসে পাসে খুঁজে দেখলে নিজ উদ্যোগে উদ্যোক্তা হওয়া ছাড়া আর কেউ নেই। এর কারণ হচ্ছে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য অর্থের প্রয়োজন। 

বেশিরভাগ উদ্যোক্তার কাছে বিজনেস শুরু করার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ থাকে না। সরকার বা ব্যক্তি পর্যায়ে এই ধরনের উদ্যোগকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যে কারণে তাকার অভাবে হিউজ পরিমাণে উদ্যোগ আলোর মুখ দেখতে পায় না। আমরা জানি প্রতিটি বিজনেস শুরুর সময়ে অনেক বেশি পরিমাণে অর্থ প্রয়োজন হয়। বেশিরভাগ উদ্যোক্তার কাছে এই ব্যাকআপ না থাকার কারণে তারা উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়ে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। 

মার্কেটিং এ অদক্ষতা

ইউএসএ এর ব্যুরো অফ লেবার স্টাটিকটিস এর মতে ২০% বিজনেস শুরু হওয়ার প্রথম ১ বছরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। বাকি ৪৫% প্রথম ৫ বছরে, ৬৫% প্রথম ১০ বছরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। মাত্র ২৫% বিজনেস ১৫ বছর বা তারও বেশি সময়ে ধরে টিকে থাকে। এখানে আপনি আপনার উদ্যোগ কতদিন পর্যন্ত নিয়ে যাবেন তা নির্ভর করে আপনার মার্কেটিং দক্ষতার উপরে। 

কারণ বিজনেস পরিচালনা করার জন্য মার্কেটিং এর কোন বিকল্প নেই। কারণ পণ্য বিক্রি করার জন্য উক্ত পণ্য কাস্টমারের কাছে পৌঁছাতে হয়। না হলে আপনার পণ্য সম্পর্কে মানুষ জানতে পারবে না এবং তার অভাব বোধ করবে না। আর আপনার পণ্য সম্পর্কে মানুষের মাঝে অভাব বা সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য আপনাকে মার্কেটিং পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য এই বিষয়ে পর্যাপ্ত দক্ষ হয়ে নেওয়া অনেক জরুরি। 

যদিও আপনি এই কাজ কর্মী হায়ার করেও করতে পারবেন। তবে আপনি নিজে করলে অতিরিক্ত অর্থ যেমন খরচ হচ্ছে না তেমনি আপনার অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে ডিজিটাল মার্কেটিং ও সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং অনেক ভালো কাজ করে। সর্বোপরি উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য মার্কেটিং বিষয়ে পর্যাপ্ত ধারণা রাখতে হবে। 

বাজার প্রতিযোগিতা

নতুন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা একদম উপযুক্ত নয়। কারণ একজন নতুন উদ্যোক্তার জন্য মার্কেটে কাস্টমার সেগমেন্ট তৈরি করা অনেক কষ্টকর হয়ে পরে। পাশাপাশি প্রোডাক্ট মার্কেটে চলবে কি চলবে না সে বিষয়েও সন্দেহ কাজ করে। অন্যদিকে যে প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করা হচ্ছে সে প্রোডাক্টে যদি অনেক বড় প্রতিষ্ঠান থাকে তাহলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। 

তাছাড়া বাংলাদেশের অসুস্থ বাজার ব্যবস্থায় নতুন উদ্যোক্তাগণ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বৈষম্যের শিকার হয়। সব মিলিয়ে নতুন পণ্যের জন্য বাজার দখল ও লসের ঝুঁকির কারণে অনেকেই উদ্যোক্তা হতে চান না। তবে সঠিক ভাবে মার্কেট রিসার্চ করে ইউনিক কিন্তু প্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে মার্কেটে আসলে এই ধরনের ঝামেলা পোহাতে হয় না। 

ঝুঁকি নিতে ভয় পাওয়া

আমরা ছোট বেলা থেকেই শুনে এসেছি ঝুঁকিহীন জীবন সব থেকে শান্তির জীবন। বড় হওয়ার সাথে সাথে এই ধারণা আমাদের মস্তিস্কে পরজীবীর মতো দানা বেঁধে থাকে। যে কারণে আমরা স্বাধীনভাবে বিজনেস শুরু না করে সরকারি চাকরি করার পেছনে ছুটে চলি। কিন্তু এখানে এত বেশি পরিমাণ কম্পিটিশন থাকার পরেও আমরা বোকা মানুষ বোকার স্বর্গে বসবাস করতে ভালোবাসি। যে কারণে আমরা উদ্যোক্তা হওয়ার থেকে দাসত্ব বরণ করে নেওয়ায় বেশি মনোযোগী। 

যাইহোক, উদ্যোক্তা হওয়া মানেই হচ্ছে ঝুঁকি নেওয়া। কারণ ঝুঁকি না নিতে পারলে উদ্যোক্তা জীবনে সফল হওয়া যায় না। এখানে সবসময় এক্সপেরিমেন্ট করার মাধ্যমে একটা নির্দিষ্ট সময় পর একটি স্টাবল পর্যায় পৌঁছানো যায়। কিন্তু আমরা আমাদের মন-মানসিকতার কারণে ঝুঁকি নিতে ভয় পাই। প্রতি বছর লাখ লাখ যুবক ঝুঁকি নেওয়ার ভয়ে তাদের মন থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন মুছে ফেলে। পাশাপাশি এই ঝুঁকি নেওয়ার ভয় আমাদের উদ্যোক্তা হতে বাধা বৃষ্টি করে। 

সৃজনশীল না হওয়া

সৃজনশীল না হওয়া

একজন উদ্যোক্তার চতুর ও সৃজনশীল হতে হবে। গৎবাঁধা নিয়মের মধ্যে থেকে কোন উদ্যোগ সফল করতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। বিশেষ করে যখন মার্কেটে কম্পিটিশন অনেক বেশি পরিমাণে থাকবে। এই ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা দিয়ে উক্ত প্রতিযোগিতা থেকে নিজেকে আলাদা করে নেওয়া সম্ভব। 

এতে যেমন মার্কেটে জায়গা করে নেওয়া সম্ভব তেমনি প্রোডাক্টের সেল বৃদ্ধি করা সহজ হবে। আমাদের দেশে বেশিরভাগ উদ্যোগ কিছুদিন পরে বিফল হওয়ার পেছনে সৃজনশীলতা অনেক বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। 

সুযোগের অভাব

উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় সময় এবং সুযোগের। কিন্তু আমাদের দেশে তরুণদের এই সময় এবং সুযোগ দিতে সরকার এবং সমাজ দুটোই নারাজ। আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেখানে লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করতে হবে। না হলে সমাজে মুখ দেখানো যাবে না। অন্যদিকে লেখা পরা করে উদ্যোক্তা হতে চাইলে তাদের কটু কথার সম্মুখীন হতে হয়। 

এই সব কিছু মিলিয়ে একজন উদ্যোক্তা তৈরির জন্য যেমন পরিবেশ প্রয়োজন তেমন পরিবেশ পাওয়া যায় না। পাশাপাশি নতুন কিছু শুরু করতে গেলে পারিবারিক থেকে শুরু করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হয়। যে কারণে উদ্যোক্তা হওয়ার চেয়ে তরুণরা চাকরি করার ক্ষেত্রে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। 

আইনি জটিলতা

বাংলাদেশে উদ্যোক্তা হওয়া অন্যান্য দেশের থেকে অনেক বেশি কঠিন। এখানে প্রতিটি পদে পদে অর্থ প্রয়োজন হয় পাশাপাশি অনেক জায়গায় হয়রানির শিকার হতে হয়। বিশেষ করে নতুন কোন উদ্যোগ নেওয়ার সময় তার লাইসেন্স থেকে শুরু করে যাবতীয় সরকারি ডকুমেন্ট করতে হলে আপনি তা সহজভাবে করতে পারবেন না। 

পাশাপাশি এমন অনেক সরকারি নীতিমালা রয়েছে যা একজন উদ্যোক্তার শুরু সময়ে মেনে চলা অনেক কঠিন হয়ে পরে। কিন্তু এই বিষয় যদি সহজ করে দেওয়া হত তাহলে কিন্তু এই ঝামেলা পোহাতে হত না। এই ক্ষেত্রে নতুন কোন উদ্যোগ নিয়ে তা প্রতিষ্ঠা করার পূর্বে একজন নতুন উদ্যোক্তার প্রথমে কোন আইনজীবী অথবা বিজনেস কনসালটেন্টের থেকে সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। 

শেষ কথা

উপরিউক্ত আলোচনায় উদ্যোক্তা হওয়ার পথে বাধা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এখানে একজন নতুন উদ্যোক্তার কি কি বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে সে সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এই বাধা গুলো অতিক্রম করার জন্য কি কি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।