প্রথম থেকে কিভাবে একটি ব্যবসা শুরু করা যায়?

একটি ব্যবসা শুরু করার আগে আমাদের সময় নিয়ে অনেক গভিরে চিন্তা করে নিতে হবে। গভিরে চিন্তা না করলে ভুল পথে যাওয়ার বা বিজনেস ফেইল হওয়ার সম্ভাবনা ৮০%। আর বাকি ২০% কোন ভাবে সফল হলেও তা সাময়িক সময়ের জন্য হবে। কারণ বিশ্ব প্রতিদিন পরিবর্তন হচ্ছে, পাশাপাশি বিশ্ব বাজারে ব্যবসায়িক পদ্ধতি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। 

নিত্যনতুন বিজনেস আইডিয়ার কারণে কম্পিটিশন অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই আপনি যদি পরিকল্পিত পদ্ধতিতে বিজনেস প্লান না করেন তাহলে লস হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। এই কারণে আমাদের আজকের লেখায় একটি ব্যবসা শুরু করার জন্য কীভাবে কাজ করা উচিত এবং কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। 

কিভাবে একটা ব্যবসা শুরু করা যায়?

নিচে কীভাবে একটি বিজনেস শুরু করা যায় সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। লেখাটি সম্পূর্ণ পড়লে আপনার মনের কনফিউশন দূর হবে এবং বিজনেস শুরু করার পূর্বে কোন ধরনের ভুল করা যাবে না সে সম্পর্কে ধারনা লাভ করবেন। 

ব্রেইনস্টর্মিং

ব্রেইনস্টর্মিং

কোন বিজনেস শুরু করার আগে সবার প্রথম কাজ হচ্ছে ব্রেইনস্টর্মিং করা। অর্থাৎ আপনি কি বিষয়ের উপরে বা কোন ধরনের প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছেন তা খুঁজে বের করতে ব্রেইনস্টর্মিং প্রয়োজন। এই ধাপে আপনাকে বিজনেসের সম্ভাবনা, রিস্ক সহ যাবতীয় বিষয়ে আইডিয়া জেনারেট করে নিতে হবে। আপনি যত গভিরে চিন্তা করতে পারবেন আপনার বিজনেস আইডিয়া তত শক্তিশালী হবে এবং সফলতার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। 

ধরুন আপনার কাছে বিজনেস শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আছে। কিন্তু আপনি যে ধরনের বিজনেসের কথা চিন্তা করছেন তা ইতোমধ্যে মার্কেটে প্রচলিত আছে। এখন আউট অফ দ্যা বক্স আইডিয়া খুঁজে বের করতে হলে আপনাকে ব্রেইনস্টর্মিং করতে হবে। আপনি অনেক পদ্ধতিতে এই কাজ করতে পারবেন। তবে নিজের খুঁজে বের করা আইডিয়া গুলো অবশ্যই নোট করে সেগুলো প্রচলিত মার্কেটের সাথে খাপ খায় কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। 

ব্র্যান্ড বিল্ডিং 

ব্র্যান্ড বিল্ডিং বা ব্র্যান্ডিং বিজনেস পরিচালনার জন্য অনেক জরুরী বিষয়। ব্র্যান্ডিং বলতে কোন বিজনেস বা প্রোডাক্টকে মানুষের কাছে স্বতন্ত্র হিসেবে পরিচিত করানো। অর্থাৎ বাংলাদেশে বিভিন্ন যায়গায় বিরিয়ানি বিক্রি হয়। একেক বিরিয়ানির একেক নাম তবে এদের মধ্যে হাজির বিরিয়ানি সবার কাছে পরিচিতি পেয়েছে। অর্থাৎ সবাই বিরিয়ানি বিক্রি করলেও হাজির বিরিয়ানি তাদের ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত করাতে পেরেছে। বিজনেস শুরু করার সময় এই বিষয়ে আপনাকে অতিরিক্ত মনোযোগ দিতে হবে। 

বিশেষ করে আপনি যদি দীর্ঘদিন বিজনেস করতে চান বা এভারগ্রিন বিজনেসম্যান হতে ইচ্ছুক হন তাহলে ব্র্যান্ডিং এর বিকল্প নেই। আপনি বেশ কয়েক ভাবে ব্র্যান্ড বিল্ডিং করতে পারবেন, যেমন প্রোডাক্ট এর স্বতন্ত্রতা, কাস্টমার ফিডব্যাক গ্রহন করা, ভ্যলু অ্যাড করা, লিডার হিসেবে নিজেকে প্রেজেন্ট করা, মার্কেটিং করা ইত্যাদি। এই পদ্ধতি গুলো অনুসরন করলে অল্প সময়ের মধ্যে আপনার ব্র্যান্ড, ভ্যালু অ্যাড করা শুরু করবে। ব্র্যান্ড বা বিজনেসকে সব সময় তদারকি করতে হবে এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 

বিজনেস স্ট্রাকচার

বিজনেসকে একে অপরের থেকে আলাদা করার জন্য প্রচলিত চারটি স্টাকচার রয়েছে। নিচে সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। 

LLC (Limited Liability Company)

এলএলসি বা লিমিটেড লায়াবিলিটি কোম্পানি একটি বিজনেস রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি। পাশাপাশি এটি বিজনেস স্ট্রাকচার হিসেবেও কাজ করে। ছোট বিজনেস প্রতিষ্ঠা করার জন্য সিমিত ব্যয়ের কোম্পানি বা LLC সব থেকে বেশি উপযুক্ত। কারণ এখানে সবথেকে বেশি যে সুবিধা পাওয়া যায় তা হচ্ছে আপনি pass-through taxation সুবিধা পাবেন। এই ট্যাক্স পদ্ধতিতে আপনাকে বিজনেস ওনার হিসেবে ট্যাক্স দিতে হবে না। 

অর্থাৎ একটি কোম্পানির উপরে ট্যাক্স বাধ্যতামূলক করার জন্য যতগুলো আইনি আদেশ আছে তা আপনার LLC এর উপর বর্তাবে না। অন্যদিকে, LLC প্রতিষ্ঠা করতে খরচ যেমন কম হয় তেমনি কোম্পানির মালামালের জন্য লিগ্যাল প্রোটেকশন পাওয়া যায়। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের মালিক একজন বা কয়েকজন হতে পারে। অথবা আপনি আপনার কোম্পানির মাধ্যমে অন্য LLC কোম্পানি কিনে মালিকানা নিতে পারবেন। 

LLP (Limited Liability Partnership)

এলএলপি অনেকটা এলএলসি এর মতো ফরম্যাট হলেও একটু ভিন্নতা রয়েছে। এখানে পার্টনারশিপের মাধ্যমে লিগ্যাল ভাবে বিজনেস প্রতিষ্ঠিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অর্থাৎ LLP তে আপনার বিজনেস রেজিস্ট্রেশন করলে পার্টনারশিপের মাধ্যমে বিজনেস পরিচালনা করতে পারবেন। এই ধরনের বিজনেস সবথেকে বেশি দেখা যায় আইনজীবী, স্থপতি ও হিসাবরক্ষকদের ক্ষেত্রে। 

এর সুবিধা গুলো LLC প্রতিষ্ঠানের মতই এবং এখানেও আপনি আপনার বিজনেসকে স্টক মার্কেটে নিয়ে যেতে পারবেন না। আবার বিজনেসের কোন পণ্যসামগ্রীর ক্ষতি হলে তা পার্টনারদের মাঝে ভাগ হয়ে যাবে। 

একক মালিকানা

একক মালিকানা প্রতিষ্ঠান মানে হচ্ছে এই ধরনের বিজনেসের মালিক শুধু একজন হয়। অর্থাৎ বিজনেসের সকল ধরনের দায়ভার, ট্যাক্স ও লিগ্যাল বিষয়গুলো শুধু মালিকের উপর বর্তায়। একক মালিকানা হিসেবে বিজনেস রেজিস্টার করলে আপনি উক্ত বিজনেস নিজের কন্ট্রোলে রেখে পরিচালনা করতে পারবেন। আপনার সিদ্ধান্ত জাস্টিফাই করার জন্য কেউ প্রশ্ন করবে না। 

এই ধরনের বিজনেসের অনেক সুযোগ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নতুন বিজনেস শুরু করার জন্য অনেকেই LLC বা কর্পোরেশন হিসেবে রেজিস্ট্রেশন না করে একক মালিকানা হিসেবে বিজনেস পরিচালনা করে। এর যেমন সুবিধা আছে তেমনি অনেক অসুবিধা রয়েছে। কর্পোরেট, LLC, LLP তে অ্যাসেট এর লিগ্যাল প্রোটেকশন পাওয়া গেলেও একক মালিকানায় সকল দ্বায়ভার আপনার নিজের উপর বর্তাবে। 

কর্পোরেশন

কর্পোরেশন বলতে একটি সংস্থা বোঝানো হয় যেখানে এক দল লোক বা কোম্পানি একক স্বত্বা হিসেবে কাজ করে। এখানে আপনি রেজিস্ট্রেশন করার সময় দুই ধরনের অপশন পাবেন যেমন S-Corp ও C-Corp। এখানে ছোট কোম্পানি গুলোর জন্য S-Corp প্রযোজ্য যা LLC এর মতো সুবিধা প্রদান করে। অন্যদিকে C-Corp স্টার্টআপ এবং বড় বিজনেস গুলোর জন্য প্রযোজ্য। 

বিশেষ করে যারা ভেঞ্চার ক্যাপিটালের মাধ্যমে ইনভেস্টমেন্ট আসা করে তাদের জন্য C-Corp হিসেবে বিজনেস রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। অন্যদিকে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান শেয়ার হোল্ডার দ্বারা গঠিত হয়। ট্যাক্সের ক্ষেত্রে ডাবল ট্যাক্স ফাইল করতে হয়। অন্যান্য বিজনেস স্ট্রাকচারের নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকলেও এর কোন মেয়াদ থাকে না। 

প্রোডাক্ট বিল্ডিং

প্রোডাক্ট বিল্ডিং

প্রথম দিকে একজন নবীন বিজনেস উদ্যোক্তা প্রোডাক্ট বিল্ডিং এর দিকে বেশি নজর দিয়ে অন্যান্য বিষয় স্কিপ করে যায়। কিন্তু আপনি যদি সফল হতে চান তাহলে অবশ্যই প্রথমে উপরে বর্ণিত পদক্ষেপ গুলো সম্পূর্ণ করে প্রোডাক্টের দিকে নজর দিতে হবে। বিজনেস আইডিয়া তৈরি করার সময় আপনি যে প্রোডাক্ট নির্বাচন করেছেন সে প্রোডাক্ট সম্পর্কে আপনার পরিষ্কার ও গভির ধারনা থাকতে হবে। মার্কেটে আপনি নতুন কোন প্রোডাক্ট নিয়ে আসতে পারেন অথবা ইতোমধ্যে রয়েছে এমন প্রোডাক্ট দিয়ে বিজনেস শুরু করতে পারেন। 

ইতোমধ্যে রয়েছে এই ধরনের প্রোডাক্ট দিয়ে বিজনেস করার জন্য আপনাকে সবার প্রথবে বাজারে থাকা উক্ত প্রোডাক্টের কোয়ালিটি উন্নত করতে হবে। একই ধরনের দুইটি প্রোডাক্ট কখনোই মার্কেটে চলে না। আপনার দূরদর্শিতা যত বেশি হবে আপনার প্রোডাক্ট নির্বাচন তত ভালো হবে। চেষ্টা করতে হবে যে কাস্টমার একবার প্রোডাক্ট নিবে সে যেন অভিযোগ করার সুযোগ না পায়। এতে একজন থেকে আরেকজন এভাবে আপনার প্রোডাক্ট পৌঁছে যাবে। 

মানি ম্যানেজমেন্ট 

ব্যক্তিগত জীবনে হোক আর ব্যাবসায়িক জীবনে হোক মানি ম্যানেজমেন্টের কোন বিকল্প নেই। বিজনেস শুরু করার আগে আপনাকে কোথায় কত টাকা কীভাবে খরচ করবেন তা নির্ধারণ করে নিতে হবে। কোম্পানির প্রথম ইনভেস্ট হিসেবে ব্যাংকে বিজনেস অ্যাকাউন্ট খোলার পর একজন একাউন্টেন্ট নিয়োগ করা অতি জরুরী। এতে বিজনেস শুরু থেকেই সকল ধরনের হিসেব গোছানোভাবে পরিচালিত হবে। পাশাপাশি যে যে খাতে ইনভেস্ট করা জরুরী সে সে খাতে সঠিক পরিমানে ইনভেস্ট হবে। এতে বিজনেস অল্প সময়ের মধ্যেই প্রফিট করা শুরু করবে। 

মার্কেটিং

লাস্ট বাট নট লিস্ট হিসেবে আছে মার্কেটিং। আপনি উপরের সব কাজ সঠিকভাবে করতে পারলেও যদি মার্কেটিং না করেন তাহলে কোন লাভ হবে না। কারণ মার্কেটিং করার ফলে আপনার বিজনেস সবার কাছে পরিচিতি পাবে। অনলাইন এবং অফলাইন দুই মাধ্যমেই মার্কেটিং করতে হবে। আপনার বিজনেসের অনেক বড় একটি অংশ মার্কেটিং এর জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে। 

মার্কেটিং করার জন্য আপনি অনেক ধরনের মিডিয়া যেমন ইন্টারনেট, টেলিভিশন, স্পন্সরশিপ, পত্রিকা, ব্যানার ইত্যাদির সাহায্য নিতে পারবেন। তবে ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে মার্কেটিং করার ফলে অনেক ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। অন্যদিকে আপনি যদি আপনার ফিল্ডের সব থেকে ভালো প্রোডাক্ট ভালো কাস্টমার সার্ভিস সহ দিতে পারেন তাহলে কাস্টমার সবসময় আপনার কাছেই আসবে। অনেক বিজনেস দেখবেন যে তাদের প্রোডাক্ট কাস্টমার নিজে মার্কেটিং করে দেয়। কাস্টমার নিজে থেকে প্রোডাক্ট মার্কেটিং করে দিলে ওভারঅল মার্কেটিং খরচ কমানো সম্ভব। 

শেষ কথা

মার্কেটে একটি দোকান দিয়ে দিলাম আর নিজেকে একজন বিজনেসম্যান হিসেবে পরিচয় দিলাম, এভাবে আসলে বিজনেস হয় না। সত্যিকার অর্থে ব্যবসায়িক হতে চাইলে আমাদের ধ্যান-জ্ঞান সবকিছুই বিজনেসে থাকা জরুরী। আজকের লেখায় শূন্য থেকে কিভাবে একটা ব্যবসা শুরু করা যায় এবং কোন পথে আগালে সফল হওয়া যাবে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশাকরি লেখাটি পড়ে আপনার বিজনেস বিষয়ক প্রাথমিক জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর পেয়েছেন।