নতুন বিজনেস প্রতিষ্ঠায় জেনে নিন ব্যবসার নিয়ম কানুন

বিজনেস শুরু করার পূর্বে কিছু প্রয়োজনীয় নিয়ম কানুন জেনে নেওয়া অনেক জরুরি। কারণ কোন রকম আইনি জটিলতা ছাড়া বিজনেস প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে এর নিয়ম কানুন মেনে চলা উচিত। নাহলে দেখা যাবে বিজনেস শুরু করার পর তা বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। যাইহোক, আমাদের আজকের লেখায় আমরা ব্যবসার নিয়ম কানুন সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো। 

বিজনেস রেজিস্ট্রেশন

ব্যবসার নিয়ম কানুনের মধ্যে সবার প্রথমে পরে রেজিস্ট্রেশন করা। কারণ প্রতিটি দেশের আইন অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন করা ছাড়া কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। অন্যদিকে বিজনেস নিবন্ধিত করার নানা রকমের সুবিধা রয়েছে। তাদের মধ্যে বিজনেস ট্রাস্ট এবং রেপুটেশন অন্যতম। পাশাপাশি আপনার বিজনেস রেজিস্টার করা থাকলে তা বণ্টন থেকে শুরু করে অন্য কোন বিষয়ে আইনি ঝামেলায় পরবে না। 

অনেক সময় দেখা যায় ক্ষমতায় থাকা অনেক ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্যের জমি দখল করে নেয়। আপনি যদি আপনার বিজনেস বড় না করেন তাহলে যে কোন সময় তা অন্য কারো দখলে গেলে আপনি আইনি সহায়তা পাবেন না। পাশাপাশি অনিবন্ধিত বিজনেস দেশের বাইরে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। এছাড়া জেলা বা জেলার বাইরে শাখা খুলতে চাইলেও আইনি ঝামেলায় পড়তে হবে। সর্বোপরি একটি লিগ্যাল বিজনেস প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে সবার প্রথমে তা নিবন্ধিত করে নিতে হবে।

বিজনেস লাইসেন্স

লাইসেন্স

বিজনেস লাইসেন্স হচ্ছে এমন জিনিস যা দ্বারা সরকার যে আপনাকে অনুমতি দিচ্ছে তা প্রমাণিত হয়। তবে আলাদা আলাদা বিজনেসের জন্য লাইসেন্সের ধরণ আলাদা হয়ে থাকে। এটি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ থেকে সংগ্রহ করা যায়। সাধারণত ট্রেড লাইসেন্স তৈরি করে নেয়াকে লাইসেন্স বলে থাকে। এটি বিজনেসের লিগ্যাল আইডেন্টিটি হিসেবে কাজ করে। 

বাংলাদেশে বিভিন্ন রকমের ব্যবসায়িক লাইসেন্স বিদ্যমান যেমন, ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, TIN আইডি, ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট লাইসেন্স, অগ্নি নিরাপত্তা লাইসেন্স এবং সেক্টর ভিত্তিক লাইসেন্স। ব্যবসায়ের ধরণ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ের উপরে নির্ভর করে কোন ধরনের লাইসেন্স নিতে হবে তা নির্ধারণ করা হয়। 

শ্রম আইন প্রতিষ্ঠা

শ্রম আইন হচ্ছে আপনার বিজনেসে যে শ্রমিক রয়েছে তাদের অধিকার ঠিক মতো আদায় হচ্ছে নাকি তা নিশ্চিত করা। প্রতিটি দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও সাংবিধানিক শ্রম আইন প্রতিষ্ঠিত আছে। কোন কারণে এইগুলা উলঙ্ঘন করা হলে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। বাংলাদেশে ২০০৬ সালে ১৯৬৫ সালের শ্রম আইনকে নতুন করে সাজিয়ে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

পরবর্তীতে ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে তা পুনরায় সংশোধন করা হয়। বিজনেস পরিচালনা করার ক্ষেত্রে শ্রম আইন প্রতিপালন করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। বিশেষ করে আইনি ঝামেলা এড়ানোর জন্য এবং কর্মীদের একটি সুন্দর এবং ফ্রেইন্ডলি কাজের পরিবেশ দেওয়ার জন্য শ্রম আইন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। 

কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার ব্যবস্থা

এটি হচ্ছে কর্মীদের শারীরিক ও মানুষিক নিরাপত্তা। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাকে Occupetional Safety and Health (OSH) বলা হয়ে থাকে। এটি একজন কর্মীর কাজ করাকালীন শারীরিক ও মানুষিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয় নিশ্চিত করে থাকে। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে কর্মক্ষেত্রে অবশ্যই নিরাপত্তার ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। এটি যেমন শ্রম আইন প্রতিষ্ঠিত করে তেমনি কাজের পরিবেশ আরও উন্নত করে। কর্মচারীদের মধ্যে কাজের স্পৃহা বৃদ্ধি পায় যা প্রোডাকশন বৃদ্ধি করে। 

কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অনেক ধরনের উপায় রয়েছে যেমন-

  • কর্মচারীদের নিয়মিত নিরাপত্তা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে
  • প্রয়োজনীয় সেফটি ইকুইপমেন্ট যেমন হেলমেট, গ্লাভস, গগলস, মাস্ক, PPE ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকতে হবে। 
  • প্রতিষ্ঠানে থাকা বৈদ্যুতিক লাইন নিয়মিত চেক করতে হবে
  • ইমারজেন্সি এক্সিট ব্যবস্থা থাকতে হবে
  • অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা থাকে হবে
  • যন্ত্রপাতি ঠিক আছে নাকি নেই সে বিষয়ে তদারকি করতে হবে
  • কর্মীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে

একটি প্রতিষ্ঠানকে গভর্নমেন্ট আইন মেনে পরিচালন আকরতে চাইলে উপরে বর্ণিত বিষয়গুলোর প্রয়োজন পরে। প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করলে কাজ যেমন অনেক গোছানোভাবে হয় তেমনি কর্মীদের ভরসা বৃদ্ধি পায়। 

ফিনান্সিয়াল রুলস

বিজনেস পরিচালনা করার জন্য প্রপার ফিনান্সিয়াল রুলস তৈরি করে নিতে হবে। এটি হচ্ছে এমন একটি বিষয় যা বিজনেসের লাভ লস ও ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করে। ছোট বা বড় যে কোন বিজনেসের জন্য আর্থিক হিসাবনিকাশ ও আয়-ব্যয়ের রেকর্ড রাখা অনেক জরুরি। অন্যদিকে সরকারি আইন অনুযায়ী কোম্পানির আর্থিক বিবরণী থাকতে হবে। পাশাপাশি প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা জানার জন্য অডিট করার প্রয়োজন পরে। ব্যাবসায়িক নথিপত্র না থাকলে অডিট করার সময় পর্যাপ্ত ডাটা পাওয়া যাবে না।

ট্রেডমার্ক ও কপিরাইট

ট্রেডমার্ক হচ্ছে আপনার কোম্পানির লোগো এবং স্লোগান সরকারিভাবে নিজের করে নেওয়া। লিগ্যালভাবে বিজনেস করতে গেলে কোম্পানি ট্রেডমার্ক করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নাহলে অন্য কোন প্রতিষ্ঠান বা আপনার কম্পিটিটর আপনার কোম্পানির নাম তার আন্ডারে রেজিস্ট্রেশন করে নিলে পরবর্তীতে আপনি সেই লোগো আর স্লোগান ইউজ করতে পারবেন না। 

আপনার যদি একের অধিক বিজনেস থাকে তাহলে ট্রেডমার্ক করার মাধ্যমে আপনি তাদের আলাদা করে ফেলতে পারবেন। প্রতি ১০ বছর পর পর ট্রেডমার্ক রিনিউ করতে হয়। বাংলাদেশে বিজনেস ট্রেডমার্ক করতে হলে প্রয়োজনীয় কাগজ ও ফি দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করতে হয়। 

কপিরাইট হচ্ছে সৃজনশীল কোন কাজকে নিজের নামে রেজিস্টার করে নেওয়া। আপনার বিজনেসে যদি সৃজনশীল কোন উপাদান বা পণ্য থাকে যেমন সাহিত্যকর্ম, সঙ্গীত, সিনেমা বা প্রোগ্রামিং কোড থাকে তাহলে সেগুলোর কপিরাইট রেজিস্টার করে নিতে হবে। এতে উক্ত প্রোডাক্টের মালিকানা শুধু আপনার কাছে থাকবে। এর মেয়াদ হয় মালিক মারা যাওয়ার পর থেকে আরও ৬০ বছর পর্যন্ত। অর্থাৎ আপনার নামে যদি কোন কিছু কপিরাইট করা থাকে তাহলে তা আপনি মারা যাওয়ার পরেও আরও ৬০ বছর আপনার নামে থাকবে। 

ট্যাক্স রেজিস্ট্রেশন

একটি দেশ পরিচালিত হওয়ার জন্য জনগণের কাছে থেকে যে অর্থ নেয় তাকে ট্যাক্স বলে। জনগণের ইনকাম ট্যাক্সের বাইরেও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ট্যাক্স দিতে হয়। তো বিজনেস শুরু করার পূর্বে আপনাকে যে কয়েকটি কাজ করে নিতে হবে তা হচ্ছে ট্যাক্স রেজিস্ট্রেশন। প্রতিষ্ঠানের ট্যাক্স ডকুমেন্ট থাকলে সরকার সেই প্রতিষ্ঠানের আয় এবং ব্যয় এর হিসেব রাখতে পারে। এতে তাঁদের আয় বৈধ না অবৈধ তা বোঝা যায়। 

ট্যাক্স রেজিস্ট্রেশন করলে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আইনি সুরক্ষা পায়। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে লোণ পেতে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না। অন্যদিকে সরকারি প্রণোদনা সহ সরকার কর্তৃক নানা সুবিধা পাওয়া যায়। সর্বোপরি ট্যাক্স প্রদান করলে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখা যায়। 

ব্যাংক অ্যাকাউন্ট

পার্সোনাল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং বিজনেস ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। বিশেষ করে এক অ্যাকাউন্ট থেকে আরেক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে বিজনেস অ্যাকাউন্ট বেশি সুবিধা দিয়ে থাকে। যেহেতু বিজনেস পরিচালনা করাকালীন বিভিন্ন আমাউন্টের আর্থিক লেনদেন করতে হবে। সেহেতু একটি বিজনেস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ক্রিয়েট করা অনেক জরুরি। 

এতে আপনার ট্রানজেকশন গুলো যেমন অনেক স্মুথ হবে তেমনি ক্লায়েন্টের সাথে টাকা নিয়ে কোন ঝামেলায় পড়তে হবে না। পাশাপাশি আপনার বিজনেসের অর্থ সংরক্ষণ করে রাখার জন্য বিজনেস ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কোনো বিকল্প নেই। 

লিখিত চুক্তি

লিখিত চুক্তি 

লিখিত চুক্তি হচ্ছে আপনি যখন কোন লেনদেন করবেন বা কোন অংশীদারিত্বে জড়াবেন তার প্রমাণ। এতে লম্বা সময় পর দুই পক্ষের মধ্যে কি চুক্তি হয়েছে তা নিয়ে কোন ধরনের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয় না। লিখিত চুক্তিপত্র থাকলে আপনার প্রতিটা কাজের প্রমাণ থাকবে। বিজনেস পরিচালনা করার ক্ষেত্রে যত ধরনের ফাইনান্সিয়াল বিষয় রয়েছে তার পাশাপাশি আইনগত বিষয়গুলো লিখিত আকারে রেখে দেওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা

অ্যানালগ বা ডিজিটাল যে কোনো ধরনের বিজনেস হোক না কেন সাইবার সিকিউরিটির কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান সময়ে আপনার বিজনেসে যেমন হোক টাতে ইন্টারনেট কোনো না কোন ভাবে প্রভাব ফেলছে। আপনার বিজনেস আসেট সহ কর্মীদের প্রফেশনাল ও পার্সোনাল লাইফ সুরক্ষিত রাখার জন্য আপনার ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। 

বিজনেস ইনস্যুরেন্স 

বিজনেস ইনস্যুরেন্স হচ্ছে কোন কারণে যদি আপনার বিজনেসে কোন ধরনের ক্ষতি হয় তা মোকাবেলা করার জন্য সহায়তা। বিজনেস পরিচালনা করার সময় যে কোনো ধরনের অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বিজনেস ইনস্যুরেন্স এই রকম দুর্ঘটনা সামলে ওঠার জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। ইনস্যুরেন্স থাকার কারণে বিজনেসে যেমন আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত হয় তেমনি, আইনি সুরক্ষা পাওয়া যায়, ব্যবসার স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পায়, গ্রাহক ও কর্মীদের আস্থা বৃদ্ধি পায় সর্বোপরি দুর্যোগ মোকাবেলা করা সহজ হয়। 

শেষ কথা

বিজনেস প্রতিস্থা করার পূর্বে আমাদের ব্যবসার নিয়ম কানুন সম্পর্কে বিষদ জ্ঞান থাকা অনেক জরুরী। কারন সঠিক নিয়ম মেনে বিজনেস না করলে যেমন লস হওয়ার চান্স থাকে তেমনি বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আর ব্যাবসায়িক ক্ষেত্রে লাভ লসের হিসেব মেইন্টেইন করা অনেক জরুরী। কারন এর মদ্ধে বিজনেস দীর্ঘ সময় চলবে কি চলবে না তা নির্ভর করে।