বাংলাদেশে একটি লিমিটেড কোম্পানি করার নিয়ম ও প্রক্রিয়া

লিমিটেড কোম্পানি একটি দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখার জন্য কাজ করে। প্রাইভেট বা পাবলিক যে কোন ধরনের কোম্পানি হোক না কেন তা অর্থনীতি উন্নয়নের পক্ষে কাজ করে থাকে। বাংলাদেশে অনেক প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠান রয়েছে যা বিভিন্ন ধরনের পণ্য ও সেবা উৎপন্ন করে থাকে। আজকের লেখায় বাংলাদেশে লিমিটেড কোম্পানি করার নিয়ম গুলো কি সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

কোম্পানি ধরণ নির্বাচন

সাধারণত লিমিটেড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড ও পাবলিক লিমিটেড এই দুই ধরনের হয়ে থাকে। কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করার পূর্বে আপনি এগুলোর মধ্যে কোন কর্পোরেট আইডেন্টিটি চাচ্ছেন তা নির্ধারণ করে নিতে হবে। মূলত প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি গুলোয় কমপক্ষে ১ জন (পূর্বে ২ জন থেকে ৫০ জন ছিল) থেকে সর্বোচ্চ ৫০ জন শেয়ারহোল্ডার থাকতে পারবে। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে সাধারণ জনগণ শেয়ার নিতে পারে না। 

অন্যদিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি গুলোয় শেয়ারের পরিমাণের কোন সীমাবদ্ধতা নেই। পাশাপাশি এখানে সাধারণ জনগণ শেয়ার নিতে পারে। আপনার কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করার পূর্বে অবশ্যই এন্টিটি কি হবে তা নির্ধারণ করে নিবেন। 

কোম্পানি ধরণ নির্বাচন

নেইম ক্লিয়ারেন্স

যে কোন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার জন্য সবার প্রথম ধাপ হচ্ছে সঠিক নাম নির্ধারণ। নাম নির্বাচন করার পর তা অ্যাভেইলেবল কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে। কারণ আপনি যে নামক নির্বাচন করবেন তা যদি অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের রেজিস্টার্ড করা থাকে তাহলে আপনি ক্লিয়ারেন্স পাবেন না। নিবন্ধন করার জন্য কোম্পানির নাম ইউনিক হতে হবে। তা অন্য কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে যাওয়া যাবে না। 

আপনার নির্বাচন করা নাম ইউনিক কিনা তা আরজেএসসির ওয়েবসাইট থেকে যাচাই করে নিতে পারবেন। সেখানে যদি আপনার কোম্পানির নাম ইউনিক হিসেবে দেখায় তাহলে ক্লিয়ারেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন। কোম্পানি নামের ছাড়পত্র পেতে চাইলে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফি ২০০+ভ্যাট নির্ধারিত ব্যাংকে জমা দিতে হবে। আরজেএসসিতে আপনার নামের রিকোয়েস্ট জমা হওয়ার পর তারা আপনার প্রস্তাব করা নামগুলো যাচাই বাছাই করবে। 

পাশাপাশি তারা উক্ত নামে কোন কোম্পানি নিবন্ধিত, ছারপত্রপ্রাপ্ত ও আবেদনকৃত রয়েছে কিনা তা চেক করে দেখবে। সব ঠিক থাকলে তাদের কাছে আপনার প্রস্তাবিত যে নাম পছন্দ হবে সেই নামকে ছাড়পত্র দেবে। এই ছারপত্রের মেয়াদ আগামী ৩০ দিন পর্যন্ত থাকবে। এবং এই সময় মধ্যেই আপনার কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করে নিতে হবে। না হলে ৩০ দিন পর আবার নতুন করে ছারপত্রের আবেদন করতে হবে। 

কোম্পানির গঠনতন্ত্র নির্বাচন

লিমিটেড কোম্পানি গঠনতন্ত্রে সাধারণত মেমোরান্ডাম অফ অ্যাসোসিয়েশন ও আর্টিকেল অফ অ্যাসোসিয়েশন উল্লেখযোগ্য। সাধারণত এই দুইটি দলিলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, শেয়ারের পরিমাণ, অথরাইজ ক্যাপিটাল ইত্যাদি বিষয় নির্ধারণ ও পরিচালিত হয়ে থাকে। 

মেমোরান্ডাম অফ অ্যাসোসিয়েশন (MoA)

এই ডকুমেন্ট হচ্ছে কোম্পানি পরিচালনা করার জন্য সংবিধান। অর্থাৎ আপনার প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কোম্পানির নাম, ঠিকানা সহ যাবতীয় বিষয়গুলো এই ডকুমেন্টে জমা থাকে। পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডারদের দায়বদ্ধতা ও প্রয়োজনীয় নিয়ম কানুন এখানে জমা রাখতে হয়। এখানে কোনো প্রকারের পরিবর্তন করতে চাইলে সরাসরি আদালতের অনুমতি নিয়ে করতে হয়। 

আর্টিকেল অফ অ্যাসোসিয়েশন (AOA)

আর্টিকেল অফ অ্যাসোসিয়েশন হচ্ছে কম্পানি পরিচালনা করার জন্য নিয়মকানুন ও সংবিধান। এখানে কোম্পানি কবে থেকে শুরু হবে, এর মূলধন কি পরিমাণ হবে, শেয়ার হস্তান্তর প্রক্রিয়া কেমন হবে, চেয়ারম্যান সহ পরিচালনা পর্ষদে কে কে থাকবে এবং এর নির্বাচন করার পদ্ধতি কেমন হবে ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ থাকে। 

অন্যদিকে পরিচালনা পর্ষদ কি কি কাজ করবে এবং তাদের ক্ষমতা কেমন হবে, বাৎসরিক সভা, কোম্পানির হিসাব নিকাশ সহ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য যা যা প্রয়োজন তা এখানে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়। এই ডকুমেন্টগুলো তৈরি করার সময় অবশ্যই কোন আইনজীবীর সহায়তা নেওয়া জরুরি। কারণ এখানে যা উল্লেখ থাকবে তা যদি কোম্পানি আইন ১৯৯৪ এর সাথে না কম্প্যাটিবল হয় তাহলে কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন হবে না। 

আরজেএসসি রেজিস্ট্রিকরণ 

বাংলাদেশ সরকার কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন দেওয়া সহ অন্যান্য বিষয় কন্ট্রোল করার জন্য যৌথমুলথন কোম্পানি ও ফার্ম সমূহের পরিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছে। নিচে কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করার জন্য যে যে ডকুমেন্ট থাকতে হবে তা দেওয়া হলো- 

  • পরিচালকের ব্যক্তিগত তথ্য
  • ম্যানেজিং ডিরেক্টরের নাম
  • চেয়ারম্যানের নাম
  • শেয়ার হোল্ডার এবং পরিচালকদের এনআইডি, TIN ও এক কপি ছবি
  • কোম্পানির ঠিকানা

কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করতে হলে প্রথমে এই ডাটা গুলো সংগ্রহ করে নিতে হবে। তারপর আরজেএসসি ওয়েবসাইট থেকে আবেদন পত্র ডাউনলোড করতে হবে। আবেদন পত্রে যে যে ডাটা দিতে বলা হয়েছে সেগুলো পুরন করতে হবে। 

আবেদনপত্র জমা দেওয়ার সময় মেমোরান্ডাম অফ অ্যাসোসিয়েশন ও আর্টিকেল অফ অ্যাসোসিয়েশন এর মূল কপি সাথে অতিরিক্ত দুই কপি, নেইম ক্লিয়ারেন্স, পরিচালক পর্ষদে থাকা সবার নাম এবং তাদের সম্মতিপত্র যোগ করে দিতে হবে। সব ডকুমেন্ট ঠিক থাকলে তা আরজেএসসির ওয়েবসাইটে আপলোড করতে হবে। আপলোড সফল হলে রেজিস্ট্রেশন ফি সহ অন্যান্য ফি দেওয়ার জন্য পেমেন্ট স্লিপ ডাউনলোড করতে হবে। পরে উক্ত স্লিপ প্রিন্ট করে তা ব্যাংকে জমা দিতে হবে।

কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন ফি 

কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন ফি 

বাংলাদেশে লিমিটেড কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন খরচ নির্ভর করে পেইড আপ ক্যাপিটাল এর উপরে। নিচে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো-

  • পেইড আপ ক্যাপিটাল ২০ লাখ পর্যন্ত হলে রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হবে ৬ হাজার টাকা।
  • পেইড আপ ক্যাপিটাল ২০ লাখ থেকে ১ কোটি পর্যন্ত হলে রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হবে ১০ হাজার টাকা।
  • পেইড আপ ক্যাপিটাল ১ কোটির উপরে হলে প্রতি এক লাখ টাকায় ১০ হাজারের উপরে রেজিস্ট্রেশন ফি ১ হাজার করে যোগ হবে।
  • কোম্পানির নাম ৩০ দিন পর্যন্ত রিজার্ভ করে রাখতে হলে ১ হাজার টাকা লাগবে।
  • মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন (MoA) এবং আর্টিকেলস অব অ্যাসোসিয়েশন (AoA)-এর জন্য স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে পর্যায়ক্রমে ২ হাজার ও ১ হাজার, মোট ৩ হাজার টাকা। 
  • বিজনেসের ধরণ অনুযায়ী ট্রেড লাইসেন্স করতে হবে যার মূল্য বিজনেস লোকেশন অনুযায়ী ২ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকার মতো হয়ে থাকে। 
  • ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (TIN) নিবন্ধন করার জন্য ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। 
  • বিজনেস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে ব্যাংক এর রেগুলেশন অনুযায়ী যা জমা দিতে হবে তার পরিমাণ।  

লিমিটেড কোম্পানি শুরু করার পূর্বে আপনাকে এই বিষয়গুলোতে কি পরিমাণ অর্থ খরচ হবে তা বের করে নিতে হবে। পাশাপাশি এই বাজেট হাতে ধরে কোম্পানির সর্বোপরি বাজেট নির্ধারণ করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন ফি হিসেব করার জন্য আরজেএসসি এর ডেভেলপ করা ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে পারবেন। 

ইন-কর্পোরেশন সার্টিফিকেট 

আরজেএসসি বা রেজিস্ট্রার অফ জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ (RJSC) উপরে উল্লিখিত ডকুমেন্ট গুলো ভালো করে পর্যালোচনা করে দেখবে যে আপনার প্রতিষ্ঠানকে সার্টিফিকেট দেওয়া যায় কি যায় না। যদি সকল ডকুমেন্ট ঠিক থাকে এবং দেশের কোম্পানি আইন অমান্য না হয় তাহলে তারা আপনার রেজিস্ট্রেশন করার সময় ই-মেইল দিয়েছেন সেখানে সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশন, সংঘ স্মারক ও সংঘ বিধি এবং ফরম ১২ পাঠিয়ে দিবে। এই ডকুমেন্ট গুলো পাওয়া মানে হচ্ছে এখন থেকে আপনার কোম্পানি বাংলাদেশ সরকারের কাছে বৈধ এবং আপনার কোম্পানি রেজিস্টার্ড। 

কোম্পানি রেজিস্টার্ড হয়ে গেলে এর পরে আপনাকে- 

এই ডকুমেন্টগুলো সংগ্রহ করতে হবে। তারপর আপনি আইনানুগভাবে আপনার ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করতে পারবেন। 

শেষকথা

উপরিউক্ত আলোচনায় আপনি কীভাবে একটি লিমিটেড কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার জন্য সরকার থেকে অনুমতি নিবেন। একাহ্নে লিমিটেড কোম্পানি করার নিয়ম ও কি কি ডকুমেন্ট প্রয়োজন সে সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেওয়া হয়েছে।