বিজনেস শুরু করার পূর্বে একটি প্রগতিশীল প্লান তরি করে নেওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ভালো মন্দ বিষয় চিন্তা না করে কখনো বিজনেস শুরু করা উচিত নয়। মুলত এস্টাব্লিশ বিজনেস ওনারদের নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তাদের বিজনেস শুরু করার প্রক্রিয়া যেভাবেই শুরু হোকনা কেন তা টিকে আছে শুধু পরিকল্পনা ও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপরে। নিচে বিজনেস শুরু করার পূর্বে প্ল্যানিং করা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
মার্কেট রিসার্চ
ধরুন আপনি ব্যাডমিন্টন খেলা অনেক পছন্দ করেন। এই খেলার সাথে আপনার আবেগ ও অনুভূতি জড়িয়ে আছে। এখন আপনি আপনার এই শখ কে বিজনেসে রুপ দিতে চাচ্ছেন এবং বিশাল বড় একটি দোকান দিয়ে দিলেন যেখানে ব্যাডমিন্টন এর সকল সামগ্রী পাওয়া যায়। আপাত দৃষ্টিতে আপনার শখের জিনিশকে আপনি প্রাধান্য দিচ্ছেন এটি অনেক ভালো তবে এখানেই আপনার ভুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। একটি বিজনেস শুরু করার আগে আপনাকে নিচে দেওয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে হবে, যেমন-
- আপনি কি করতে বেশি ভালোবাসেন?
- আপনি কি করতে অপছন্দ করেন?
- আপনি জিবনে কি কি সমস্যার মধ্যে পরছেন এবং সেগুলোর সমাধান কি জানেন?
- আপনি কোন বিষয়ে ভালো?
- মানুষ আপনার কাছে কোন বিষয়ে পরামর্শ নিতে আসে?
- আপনাকে যদি কোন বিষয় নিয়ে ৫ মিনিট বক্তৃতা দিতে বলা হয় তাহলে কোন বিষয় নির্বাচন করবেন?
- আপনি কোন কাজটি সবসময় করতে চেয়েছেন কিন্তু রিসোর্স এর অভাবে করতে পারেন নি?
এই উত্তর গুলো যদি আপনার জানা থাকে তাহলে আপনি ইতোমধ্যে জেনে গেছেন আপনার কি নিয়ে বিজনেস করা উচিত। পরের ধাপে আপনাকে মার্কেট রিসার্চ করে নিতে হবে। বেশীরভাগ বিজনেস কনসাল্টেন্ট বলেন যে আপনি যে কাজ করতে পছন্দ করেন সে বিষয়ের উপরে বিজনেস করেন। তবে এখানে আপনাকে নিম্নোক্ত দুইটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে, যেমন-
- আপনি যা পছন্দ করেন তা কি প্রফিটেবল বা এর থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবেন?
- এই বিষয় পছন্দ করার পাশাপাশি আপনি কি উক্ত বিষয়ে অনেক ভালো বা দক্ষ?
মার্কেট রিসার্চ করার আগে আপনাকে এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ ব্রেইনস্টর্মিং করে আপনি এমন একটি বিষয়ে বিজনেস শুরু করলেন যার মার্কেটে তেমন ভ্যালু নেই। এতে আপনার ইনভেস্টমেন্ট যেমন নষ্ট হয়ে যাবে তেমনি আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট হবে।
যাইহোক, মার্কেট রিসার্চ করার জন্য আপনি SWOT (Strengths, Weaknesses, Opportunities, Threats) এই মেথডের সাহায্য নিতে পারেন। এতে আপনার বিজনেস গ্রো করার পাশাপাশি সহজেই কম্পিটিটরকে পেছনে ফেলতে পারবেন। এটি একটি ফ্যাক্ট নির্ভর এনালাইসিস পদ্ধতি। যা বিভিন্ন ফ্যাক্টের উপর নির্ভর করে আপনাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে।
বিজনেস প্ল্যান
এখানে আপনাকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। কারণ আপনার বিজনেস প্লানের উপর নির্ভর করে আপনার স্বপ্নের ভবিষ্যৎ, আপনার কোম্পানি বা টিম এর ভবিষ্যৎ এবং ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট। সহজ কথায় বলতে গেলে আপনি কীভাবে বিজনেস পরিচালনা করবেন তা যদি প্লান করা না থাকে তাহলে সকল কাজ অগোছালো হয়ে পড়বে। অন্যদিকে পরবর্তীতে যখন কোন ইনভেস্টমেন্ট পাবেন তখন তারা কিন্তু আপনার বিজনেস প্লান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইবে। এই জন্য আপনার বিজনেস প্লান ডকুমেন্ট আকারে সুন্দর করে সাজাতে হবে।
এতে ইনভেস্টর আপনার বিজনেস সম্পর্কে ধারনা পাবে। পাশাপাশি আপনি বিজনেসের কোথায় ভুল হচ্ছে বা কোন বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে তা নির্ধারণ করতে পারবেন। যাইহোক, বিজনেস প্ল্যানিং করার সময় আপনাকে যে যে বিষয় মাথায় রাখতে হবে তা নিচে দেওয়া হলো-
- কোম্পানির ডেসক্রিপশন
- মার্কেট রিসার্চ
- প্রতিষ্ঠানের গঠন
- মিশন এবং লক্ষ্য
- পণ্য বা সেবা
- মার্কেটিং প্ল্যান
- ফাইনান্সিয়াল প্ল্যান
এগুলো সঠিক ভাবে করা হয়ে গেলে আপনাকে আরও ৩টি বিষয়ে প্ল্যান করে রাখতে হবে। নিচে তা বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
এক্সিট প্ল্যান
এটি হচ্ছে আপনি যদি বিজনেস থেকে অবসর নেন, ব্যবসায় লস হয়, বিক্রি করে দেন তাহলে নিজেকে আলাদা করে নিবেন কীভাবে? একজন সচেতন বিজনেস ওনার হিসেবে আপনাকে বিজনেসের শুরুতেই এই প্ল্যান করে রাখতে হবে। আপনি যদি আপনার ব্যবসার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ ধারনা করতে না পারেন তাহলে বিজনেস মডেল ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। অন্যদিকে কোন কারণে যদি কোম্পানি বা বিজনেস বিক্রি করার প্রয়োজন পরে তখন বিষয়গুলো কীভাবে হ্যান্ডেল করবেন সে বিষয়ে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখাতে হবে।
পরিমাপযোগ্য বিজনেস মডেল
বিজনেস মডেল তৈরি করার সময় আপনাকে কোন সেক্টরে কি পরিমাণ খরচ হবে এবং তা কতদুর পর্যন্ত ঠিক আছে তা নির্ধারণ করে নিতে হবে। এতে বিজনেস বড় হওয়ার সাথে সাথে যখন নতুন কাস্টমার আসবে তাদের সার্ভিস প্রদান করতে যেন অনেক বেশি পরিমানে খরচ করতে না হয় তা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হবে।
ট্যাক্স
বিজনেস পরিচালনা করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের আইন অনুযায়ী আপনাকে কয়েক ধরনের ট্যাক্স দিতে হতে পারে। যেমন ইনকাম ট্যাক্স, সেলস ট্যাক্স, প্রোপার্টি ট্যাক্স, সেলফ ইমপ্লয়মেন্ট ট্যাক্স ইত্যাদি। আইনি সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে আপনাকে এই বিষয়ে পরিকল্পনা সাজিয়ে নিতে হবে।
সঠিক বিজনেস টুল
বিজনেস সঠিক পদ্ধতিতে পরিচালনা করার জন্য এবং অল্প সময়ে বেশি কাজ করার জন্য বিজনেস টুলের সহায়তা নেওয়া জরুরী। যে যে টুলস থাকলে আপনার বিজনেস সামনের দিকে অনেক দ্রুত অগ্রসর হবে সেগুলো নিচে দেওয়া হলো-
- একাউন্টিং সফটওয়্যার
- CRM সফটওয়্যার
- প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার
- ক্রেডিট কার্ড সলিউশন
- পয়েন্ট অফ সেল (POS) সফটওয়্যার
- মার্চেন্ট সার্ভিস
- ইমেইল হোস্টিং
উপরে বর্ণিত টুল আপনার বিজনেস সচল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে। এই সকল টুলের আলাদা আলদা কাজ থাকলেও সবগুলো বিজনেসে সেল আনার জন্য একত্রে কাজ করে। অন্যদিকে এই টুল গুলো আপনার অনেক কাজ অটোমেটিক করে দিবে। যা আর্থিক দিক থেকে আপনাকে লাভবান করবে এবং আপনি বিজনেসে ফোকাস ধরে রাখতে পারবেন।
আইনি প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশে তথা যে কোন যায়গায় বিজনেস প্রতিষ্ঠা করতে গেলে লাইসেন্স অ্যান্ড লিগ্যাল স্টেপ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা রাখতে হবে। বাংলাদেশে সচরাচর যে ধরনের কোম্পানি লাইসেন্স নেয় তারা সাধারণত লিমিটেড কোম্পানি হয়ে থাকে। অর্থাৎ আপনার বিজনেসকে লিগ্যাল করার জন্য আপনাকে লিমিটেড লাইসেন্স নিতে হবে।
এতে আপনার বিজনেস একটি স্বাধীন স্বত্বা হিসেবে কাজ করবে। অন্যদিকে শেয়ার হোল্ডাররা কোম্পানির দ্বায়বদ্ধতার জন্য শুধু তাদের শেয়ারের দায়বদ্ধতা বহন করে। তো আপনার নতুন শুরু করা বিজনেসকে লিগ্যাল করার জন্য লাইসেন্সের আবেদন করতে হবে। বাংলাদেশে আবেদন করতে চাইলে আপনাকে লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে আবেদন করতে হবে।
সবার প্রথমে আপনার বিজনেসের জন্য একটি সুন্দর ও সাবলিল নাম পছন্দ করতে হবে। নাম নির্বাচন করার ক্ষেত্রে আপনাকে অনেক বিষয় মাথায় রাখতে হবে, যেমন-
- কোন নাম দেশের আইনে নিষিদ্ধ
- নিবন্ধিত অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা যাবে না
- সহজে যাতে মানুষ বুঝতে পারে এমন নাম রাখতে হবে
এর পর দেশের আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট রেডি করতে হবে। কি কি ডকুমেন্ট লাগবে তা বাংলাদেশ সরকারের এই যৌথ মূলধন পরিদপ্তর থেকে দেখে নিতে পারবেন।
মার্কেটিং স্ট্রাটেজি তৈরি
বর্তমান মার্কেট হচ্ছে স্ট্রাটেজিক মার্কেট। কখন কোন স্ট্রাটেজি কাজ করবে তা আসলে বোঝা যায় না। এই কারণে কয়েক ধরনের স্ট্রাটেজি তৈরি করে তা সময়ে সময়ে অ্যাপ্লাই করে দেখা উচিত। এতে কোন পদ্ধতি বেশি কাজ করে তা বোঝা যায়। বিজনেসে স্ট্রাটেজি পরিবর্তন বলতে সেটা মার্কেটিং পদ্ধতি পরিবর্তন অথবা বিভিন্ন প্রোডাক্ট নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট হতে পারে।
স্ট্রাটেজি তৈরি করার সময় আমাদের যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখতে হবে তা হচ্ছে কাস্টমার কি চায়। অর্থাৎ আমার ভালো লাগে জন্য এই প্রোডাক্ট চলবে এমন কোন কথা নেই। অন্যদিকে কাস্টমারকে কীভাবে অ্যাাপরোচ করা হচ্ছে তার উপরেও বায়িং সিগন্যাল কাজ করে। তো বিজনেস শুরু করার আগে কি কি স্ট্রাটেজিতে কাজ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যাবসায়িক সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক জরুরী।
শেষ কথা
গবেষণায় দেখা গেছে একটি বিজনেস যে যে কারনে ব্যারথ হয় তার মদ্ধে পরিকল্পনার অভাব অন্যতম। এখানে একটি বিজনেস শুরুর পূর্বে প্ল্যানিং করার উপকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। সাধারণত ব্যাবসায়িক ক্ষেত্রে সফলতা পেতে হলে আমাদের এই বিসয়ে একটু বেশি নজর দেওয়া জরুরী।