ব্যবসায় লাভ ও লস অনেক গুলো বিষয়ের উপরে নির্ভর করে থাকে। ছোট, মাঝারি বা বড় যে কোন সাইজের বিজনেস যে কোনো সময় লসের সম্মুখীন হতে পারে। কিছু পূর্বপরিকল্পনা ও সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করার মাধ্যমে আমরা ব্যবসায় লস এড়াতে পারি। নিচে কি কি কারণে বিজনেসে লসের মুখ দেখতে হয় ও ব্যবসায় লস হওয়ার কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
অভিজ্ঞতা ছাড়া বিজনেস শুরু করা
শুধু বিজনেস নয় চলার পথে অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে রক্ষা করে। কোন কাজ শুরু করার আগে সেই কাজ সম্পর্কে যদি আমাদের জানা না থাকে তাহলে উক্ত বিষয়ের যে গোপনীয়তা জানা দরকার তা জানতে পারবো না। এতে হবে কি যে বিপদে পড়ার পাশাপাশি ভুল করার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে।
যাইহোক, অভিজ্ঞতা ছাড়া বিজনেস শুরু করা আর অথৈ সাগরে ভেসে বেরানো একই কথা। হাজার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত কূল খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ বিজনেস হচ্ছে অন্য মানুষের কাছে পণ্য বা সেবা বিক্রি করে আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হওয়া। এখন আপনি যে বিজনেস শুরু করছেন তা সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা না নিলে কি কাস্টমার আকৃষ্ট করতে পারবেন?
অন্যদিকে প্রতিটি বিজনেস ধরনের আলাদা আলাদা কি পয়েন্ট থাকে। এই পয়েন্টগুলো সম্ভাব্য কাস্টমারকে সন্তুষ্ট কাস্টমারে পরিণত করে। আর উক্ত বিজনেস সম্পর্কে অভিজ্ঞতা না থাকলে আপনি যেমন কি পয়েন্টগুলো ধরতে পারবেন না তেমনি ইনোভেশনের মাধ্যমে নতুন কাস্টমার আকৃষ্ট করতে বিফল হবেন।
অল্প টাকায় বিজনেস শুরু করা
বিজনেসে টাকা অনেক বড় একটি ফ্যাক্টর। অল্প টাকা নিয়ে বিজনেস শুরু করাকে বড় খাটে ছোট বেড শিট এর সাথে তুলনা করা হয়। আপনি একপাশে বেডশিট সমান করবেন তো ওপর পাসে ফাঁকা পরে যাবে। বিজনেসের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। অল্প টাকায় ব্যবসা শুরু করলে কাস্টমারের চাহিদা পূরণ করতে পারবেন না। এতে আপনার কাছে কাস্টমার দুইদিন কোন পণ্য বা সেবা নিতে এসে যদি ঘুরে যায় তাহলে সে আর একবারও আসবে না।
দুইবার ঘুরিয়ে দেওয়ার পর আপনি তার কথা চিন্তা করে উক্ত পণ্য নিয়ে আসলেন কিন্তু তা আর বিক্রি হবে না। পাশাপাশি উক্ত কাস্টমার ওয়ার্ড অফ মাউথ মার্কেটিং এর মাধ্যমে নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট ফেলবে। এখন কোন ধরনের বিজনেসে কি পরিমাণে ইনভেস্ট করতে হবে তা আপনি উক্ত বিজনেস সম্পর্কে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বুঝতে পারবেন।
বিজনেসে লস করার জন্য অভিজ্ঞতা না থাকার পাশাপাশি অপর্যাপ্ত ইনভেস্ট ক্ষতির কারণ হয়। এতে হিতে বিপরীত হয় এবং মার্কেটে নাম খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। কারণ অল্প ইনভেস্টে বিজনেস শুরু করলে কাস্টমারের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করা যায় না। যদিও কাস্টমারের সব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব না তবে ন্যূনতম সাপোর্ট দেওয়া জরুরি। মূলধন অল্প হলে ন্যূনতম সাপোর্ট দেওয়াও অনেক কঠিন হয়ে পরে। এতে ব্রান্ড রেপুটেশন ও ভ্যালু দুটিও কমে যায়।
নিয়মিত সেল না আসা
বিজনেসে লাভ এবং লসের সাথে সেল সরাসরি জড়িত। সেল যত কমবে প্রফিট তত কমে যাবে এবং সর্বোপরি বিজনেসে লস গুনতে হবে। যাইহোক, বিজনেসে সেল কমে যাওয়া স্বাভাবিক। একটি বিজনেস সারা জীবন প্রফিটে চলবে এমন কোনো কথা নেই। তবে চিন্তা শুরু হয় তখন যখন মাসের পর মাস বিজনেস প্রফিট করতে পারে না।
রানিং বিজনেসে লসে থাকা আর নতুন বিজনেসে লসে থাকা দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। যখন রানিং বিজনেসে লস হতে থাকে তখন বুজতে হবে হয় প্রোডাক্টে ঝামেলা আছে অথবা কাস্টমারের মন মতো হচ্ছে না। আবার যদি নতুন বিজনেস হয় তাহলে বুজতে হবে যে প্রোডাক্ট টি ইতোমধ্যে মার্কেটে আছে এবং অনেক ভালো কোয়ালিটি আছে অথবা মার্কেটে উক্ত প্রোডাক্টের চাহিদা একে বাড়েই নেই।
অন্যদিকে নতুন বিজনেসে সেল না আসার কারণ গুলোর মধ্যে বিজনেস লোকেশন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ বিজনেস যে এলাকায় দেওয়া উচিত সেখানে দেখে নিতে হবে কি পরিমাণ কাস্টমার রয়েছে এবং প্রোডাক্টটি তাদের কতদিন পর পর প্রয়োজন পড়বে। সর্বোপরি নিয়মিত সেল না আসলে কস্ট কাটিং এর পর লস ছাড়া লাভের মুখ দেখা যায় না।
পণ্যের দাম অতিরিক্ত হলে
প্রোডাক্ট এর দাম হুট করে বেড়ে গেলে কাস্টমারের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ধরুন একটি এজেন্সি ১০ হাজার টাকায় ফেসবুকে অ্যাড দিয়ে দিতো। কিন্তু বর্তমানে সেই একই সার্ভিস দেওয়ার জন্য তারা ১৫ হাজার টাকা চার্জ করে। এখন যে কাস্টমার তাদের এই সার্ভিস আগে নিয়েছিল তাদের কাছে ১৫ হাজার টাকা চাইলে কিন্তু তারা একটু কনফিউজ হয়ে যাবে।
নতুন ক্লাইন্ট হলে তাদের পূর্বের এবং এখনকার প্রাইস দেখে অতিরিক্ত মনে করলে অন্য এজেন্সির কাছে চলে যাবে। আবার অনেক পুরাতন ক্লাইন্ট হুট করে দাম বাড়ানোর কারণেও চলে যেতে পারে। তবে দাম বাড়ানো যদি রিজোনেবল হয় তাহলে বিষয় তা অন্য পর্যায় চলে যাবে। যাইহোক, অপ্রত্যাশিতভাবে দাম বৃদ্ধি করলে তা সেলের উপরে এবং বিজনেসের ভাবমূর্তির উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। যা ব্যাপক আকারে ঘটলে বিজনেসে লসের সৃষ্টি করে।
ভালো কাস্টমার সার্ভিস না দিতে পারলে
কাস্টমার সার্ভিস রিপ্রেজেন্টস ব্র্যান্ড ভ্যালু অ্যান্ড প্রফেশনালিজম। মানুষের মধ্যে একটি সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্ট আছে যে কেউ আমাদের সাথে ভালো আচরণ করলে তার প্রতি আকর্ষিত হই। যেমন অনেক ব্রান্ড বা বিজনেস রয়েছে যারা ভালো কাস্টমার সার্ভিস দেওয়ার কারণে মানুষের পছন্দের লিস্টে থাকে। এটা অনেকটা মানুষ যেখানে সম্মান বেশি পায় সেখানে বেশি যায়।
অন্যদিকে বিজনেসে খারাপ কাস্টমার সার্ভিস দিলে সেখানে চোখ বন্ধ করে লসের মুখে পরতে হবে এটা নিশ্চিত। ভালো কাস্টমার সার্ভিস অনেক ভাবেই এনশিওর করা যায়। তবে যারা প্রোডাক্ট বা ব্রান্ড রিপ্রেজেন্ট করে তাদের কাস্টমারের সাথে ভালো আচরণ করা অনেক জরুরি। অন্যথায় কাস্টমার অন্য ব্র্যান্ডে মুভ করে এবং বিজনেসে প্রফিটের গ্রাফ নিচের দিকে নামতে শুরু করে।
মার্কেটিং এ দুর্বলতা
মার্কেটিং হচ্ছে কোন পণ্য বা সেবা যাদের উক্ত পণ্য বা সেবা প্রয়োজন তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। অর্থাৎ কাদের জন্য প্রোডাক্টটি তৈরি করা তাদেরকে উক্ত প্রোডাক্ট খুঁজে পেতে সাহায্য করার কাজ করে মার্কেটিং। মার্কেটিং সঠিক ভাবে করতে পারলে যেমন প্রোডাক্ট এর সেল বৃদ্ধি পায় তেমনি দুর্বল মার্কেটিং এর কারণে সেল কমে যায়। কারণ যখন বেশি মানুষের কাছে সার্ভিস বা প্রোডাক্ট পৌঁছাবে না তখন বেশি মানুষ উক্ত প্রোডাক্ট সম্পর্কে জানবে না। না জানলে আশানুরূপ সেল হবে না যা পক্ষান্তরে বিজনেসে লসের কারণ হবে।
ব্যবসায় ক্ষতির হিসাব?
ব্যবসায় ক্ষতির হিসেব বের করা অনেক প্রয়োজনীয়। কারণ কি পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তা বের না করলে বিজনেসের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়বে। কারণ বিজনেসে আয় এবং ব্যয় এর হিসেব করে লাভ হচ্ছে না লস হচ্ছে তা নিশ্চিত হতে হয়। এই ক্ষেত্রে লসের পরিমাণ বেশি হলে কীভাবে বিজনেস সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে সে সম্পর্কে পরিকল্পনা তৈরি করা যায়। নিচে কি কি উপায়ে বিজনেসে ক্ষতির হিসেব করা যায় তা বর্ণনা করা হলো।
মোট আয়
বিজনেসে কি পরিমাণে ক্ষতি হয়েছে তা বের করার জন্য মোট আয় বের করা হয়। মোট আয়ের মধ্যে থাকে কি পরিমাণে পণ্য বা সেবা বিক্রি হয়েছে এবং তাদের দাম কেমন ছিল তার সমষ্টি। ধরুন আপনি ১০ টি মোটরসাইকেল ১ লাখ টাকা করে বিক্রি করলেন। এখান থেকে আপনার মোট আয় হবে ১০*১০০০০০= ১০০০০০০ বা ১০ লাখ টাকা।
মোট খরচ
মোট খরচ সাধারণত স্থায়ী ও পরিবর্তনশীল খরচের দ্বারা হিসেব করা হয়। এখানে স্থায়ী খরচ বলতে কর্মচারীর বেতন, অফিস ভারা, ইন্টারনেট বিল ইত্যাদি। অন্যদিকে পরিবর্তনশীল খরচের মধ্যে কাঁচামাল, উৎপাদন খরচ, ট্রান্সপোর্টেশন ইত্যাদি অন্যতম। মোট খরচ থেকে মোট আয় বাদ দিলে বিজনেসের লাভ এবং লস দুইটাই পাওয়া যায়।
মোট লাভ ও ক্ষতি নির্ধারণ
মোট লাভ ও ক্ষতি নির্ধারণ করার জন্য প্রথমে মোট আয় ও মোট ব্যয় হিসেব করে নিতে হয়। পরে মোট আয় থেকে মোট ব্যয় বাদ দিলে যদিতা আয়ের থেকে ব্যয়ের পরিমাণ বেশি হয় তাহলে ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে ধরা হয়। আবার যদি আয়ের থেকে ব্যয়ের পরিমাণ কম হয় তাহলে ব্যবসায় লাভ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।
লস মার্জিন নির্ধারণ
লস মার্জিন বের করা হলে বিজনেসে কি পরিমাণে ক্ষতি হয়ে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। সাধারণত লস মার্জিন হিসেব করতে হলে মোট লাভ এবং মোট লস একসাথে ভাগ করে তা দিয়ে ১০০ গুণ করতে হয়। এতে লস মার্জিনের পরিমাণ বেরিয়ে আসে। লস মার্জিন বের করার সূত্র নিচে দেওয়া হলো।
ক্ষতির হার (%) = (ক্ষতির পরিমাণ ÷ মোট আয়) × ১০০
এখানে প্রথমে ক্ষতির পরিমাণ বের করতে হবে এবং তা দিয়ে মোট আয় ভাগ করতে হবে। তারপর ফলাফল দিয়ে ১০০ গুণ করলে যে ফলাফল আসবে তা হবে মোট ক্ষতির হার। অর্থাৎ আপনার বিজনেস থেকে কত পারসেন্ট ক্ষতি হয়েছে তা বোঝা যায়।
অপারেটিং ও নেট লস নির্ধারণ
বিজনেসে ক্ষতি হিসেব করার জন্য এই পদ্ধতি অনেক কাজে লাগে। এখানে অপারেটিং লস বলতে পণ্য বিক্রি কম হওয়া ও হঠাৎ করে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়াকে বোঝায়। অন্যদিকে নেট লস হচ্ছে ব্যবসা থেকে মোট আয় যত এসেছে তা থেকে অন্যান্য খরচ যেমন ঋণের সুদ, ট্যাক্স ও অন্যান্য নন-অপারেটিং খরচ বাদ যাবে।
শেষ কথা
যখন কোন বিজনেসে কি কারণে লস হচ্ছে তা বোঝা যায় তখন লসকে লাভের দিকে মুভ করানো সহজ হয়। কারণ বিজনেস হোক আর জীবন, প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে ভুল গুলো থেকেই শিক্ষা নিতে হয়। যাইহোক, এই লেখায় ব্যবসায় লস হওয়ার কারণ ও ব্যবসায় ক্ষতির হিসেব নির্ধারণ করার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।