কর্পোরেট ম্যানেজমেন্ট স্ট্রাকচার বা কর্পোরেট কাঠামো কি? 

প্রতিষ্ঠান যত বড় হবে তা পরিচালনা করার জন্য তত বেশি লোকের প্রয়োজন পরবে। কর্মচারী যত বেশি হবে তাদের ম্যানেজ করার জন্য ম্যানেজমেন্টের প্রয়োজন পরবে। বর্তমানে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান গুলো পরিচালনা করার জন্য কয়েক ধরনের ম্যানেজমেন্ট স্ট্রাকচার প্রচলিত রয়েছে। এই স্ট্রাকচার অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। নিচে কর্পোরেট কাঠামো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। 

কর্পোরেট কাঠামো

কর্পোরেট কাঠামো কি এবং এতি কিবভাবে কাজ করে সে সম্পরে নিছে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। 

শেয়ার হোল্ডার

একটি কর্পোরেশনের মূল মালিক হচ্ছে শেয়ার হোল্ডার বা স্টকহোল্ডার। কারণ শেয়ার হোল্ডারদের ইনভেস্ট করা অর্থের উপর ভিত্তি করে কর্পোরেশন তৈরি হয়ে থাকে। কোম্পানিতে শেয়ার হোল্ডারদের শেয়ারের পারসেন্টেন্স হিসেবে তারা কি কি অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা পাবে তা নির্ধারিত থাকে। শেয়ার হোল্ডারগন পুরো কোম্পানির মালিক হিসেবে থাকলেও প্রতিষ্ঠানদের প্রতিদিনের পরিচালনা কাজে অংশগ্রহণ করে না। 

তাদের উদ্দেশ্য থাকে একটি উচ্চ পর্যায়ের কার্যকরী পর্ষদ নির্বাচিত করে তাদের হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া। পরবর্তীতে বার্ষিক মিটিং করার মাধ্যমে কর্পোরেশন উন্নতি করছে না অবনতি করছে এই বিষয়ে তদারকি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। কর্পোরেশনের শেয়ার হোল্ডার হিসেবে মানুষ, প্রতিষ্ঠান অথবা কোন কোম্পানি থাকতে পারে। কর্পোরেশনগুলোতে এক বা একাধিক শেয়ার ক্রয় করা যায়। মূলত কেউ যদি মোট শেয়ারের ৫০% কিনে ফেলে তবে তাকে বা উক্ত প্রতিষ্ঠানকে মেজরিটি শেয়ার হোল্ডার এবং যারা ৫০% এর নিচে শেয়ারের মালিক তাদের মাইনরিটি শেয়ারহোল্ডার বলা হয়ে থাকে। 

শেয়ার হোল্ডারদের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় দায়িত্ব হচ্ছে বোর্ড অফ ডিরেক্টরস নির্বাচন করা। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানদের ভবিষ্যৎ সুনির্দিষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কাজও তারা করে থাকেন। অন্যদিকে তারা চাইলে কোম্পানির সিইও কে অপসারণ থেকে শুরু করে নির্বাচিত বোর্ড ভেঙ্গে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে।  

বোর্ড অফ ডিরেক্টরস

বোর্ড অফ ডিরেক্টরস

বোর্ড অফ ডিরেক্টরস হচ্ছে কোম্পানি পরিচালনা করার জন্য গভর্নিং বডি বা পরিচালনা পর্ষদ। প্রতিটি পাবলিক কর্পোরেশনের বোর্ড অফ ডিরেক্টরস থাকা বাধ্যতামূলক। তবে অনেক প্রাইভেট বা নন-প্রফিট কর্পোরেশন বোর্ড অফ ডিরেক্টরস নিয়োগ দিয়ে থাকে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে কোন কর্পোরেশনে শেয়ার হোল্ডার সরাসরি ম্যানেজমেন্টের কাজ করে না। এই কাজ গুলো করার পাশাপাশি স্টেকহোল্ডার দের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য বোর্ড  কাজ করে থাকে। 

প্রতিষ্ঠান পরিচালনা থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কাজ বোর্ডের উপর থাকে। সর্বোপরি, পরিচালনা পর্ষদের হাতে নতুন প্রোজেক্ট শুরু করা থেকে শুরু করে কোম্পানি বড় করা ও নতুন কোন কোম্পানিকে কিনে নেওয়া এই সকল বিষয়ের ক্ষমতা থাকে। অন্যদিকে ম্যানেজমেন্টের জন্য নতুন নিয়োগ ও তাদের কার্যকলাপ পরিচালনা করার দায়িত্ব ডিরেক্টরদের হাতে থাকে। 

আমরা জানি পাবলিক কর্পোরেশনে বোর্ড অফ ডিরেক্টর থাকা বাধ্যতামূলক। তবে সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য প্রাইভেট ও ননপ্রফিট কর্পোরেশন গুলোও পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন করে থাকে। কর্পোরেট নিয়ম অনুযায়ী একটি ডিরেক্টরস বোর্ডে পাবলিক কর্পোরেশনের জন্য সর্বনিম্ন ৩ জন থেকে সর্বোচ্চ ১৫ জন সদস্য থাকতে হবে। অন্যদিকে প্রাইভেট কর্পোরেশনে ২ জন থেকে উপরে ১৫ জন পর্যন্ত সদস্য থাকবে। এবং এদের মধ্যে অবশ্যই মহিলা সদস্য থাকতে হবে। 

চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (CEO)

কর্পোরেট দুনিয়ায় এই টার্ম বহুল পরিচিত। কোম্পানি পরিচালনায় এই পদ অনেক শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত প্রতিষ্ঠানের লিডার হিসেবে এবং বোর্ড এর সাথে কোম্পানির সংযোগকারী হিসেবে সিইও কাজ করে থাকে। এই পদের প্রধান কাজ হচ্ছে বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের দেওয়া পরামর্শ ও দায়িত্ব কোম্পানির সবার মাঝে ভাগ করে দিয়ে ফলাফল আদায় করে নেওয়া। চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার একটি কর্পোরেট কোম্পানির ডিসপ্লে হিসেবে কাজ করে। 

তার কর্মদক্ষতা ও দূরদর্শিতার উপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠান টিকে থাকবে কি থাকবে না। অনেক কোম্পানি তাদের সিইও দ্বারা নতুন নতুন ইনভেস্টরদের আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়ে থাকে। একজন চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসারের মধ্যে লিডারশিপ গুণ থাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি কমিউনিকেশন ও ডিসিশন মেকিং দিক গুলোয় কৌশলী হতে হয়। এতে প্রতিষ্ঠান তার শর্ট-টার্ম ও লং-টার্ম দুই ধরনের উদ্দেশ্য পুরন করতে পারে। 

চিফ ফাইনান্সিয়াল অফিসার (CFO)

চিফ ফাইনান্সিয়াল অফিসারের প্রধান কাজ হচ্ছে কর্পোরেশনের আর্থিক দিক গুলো দেখা। অর্থাৎ কোম্পানি পরিচালনায় যে সকল আর্থিক বিষয় রয়েছে সে সকল বিষয় দেখার দায়িত্ব থাকে চিফ ফাইনান্সিয়াল অফিসারের উপরে। কর্পোরেট স্ট্রাকচার এই পদের কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, ফাইনান্সিয়াল প্ল্যানিং, আর্থিক বিবরণী তৈরি ও ইনভয়েস থেকে শুরু করে সকল আর্থিক লেনদেনের হিসেব সংরক্ষণ করা। 

পাশাপাশি বাজেড তৈরি ও কোন খাতে কি পরিমাণ অর্থ লাগবে বা কি পরিমাণ খরচ করা ঠিক হবে সে সম্পর্কে সম্ভাব্য রিপোর্ট তৈরি করা। অন্যদিকে কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ইনভেস্ট করার বিষয় গুলো দেখার দায়িত্ব সিএফও এর উপর থাকে। পাশাপাশি নতুন কোন কোম্পানি কিনে নেওয়ার আর্থিক দিক ও কর্পোরেশনের ঋণ ও পাওনা বিষয় গুলো দেখতে হয়। 

চিফ অপারেটিং অফিসার (COO)

কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে চিফ অপারেটিং অফিসারের কাজ হচ্ছে মার্কেটিং থেকে শুরু করে সেলস, প্রোডাকশন ও ইন্টারনাল ম্যানেজমেন্ট বিষয় তদারকি করা। এই পদের কাজ হচ্ছে কোম্পানির প্রতিদিনের কাজ ঠিকভাবে চলছে নাকি সে বিষয়ে খেয়াল রাখা। অন্যদিকে কর্পোরেটে থাকা বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া।

সিওও কোম্পানির বিভিন্ন অপারেশন্স যেমন প্রোডাকশন কেমন চলছে, কত সময়ে মধ্যে কি পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করতে হবে, কীভাবে উৎপাদন খরচ কমানো যাবে এবং নতুন নতুন উদ্ভাবন ইত্যাদি বিষয় দেখে থাকে। সর্বোপরি এই পদের কাজ হচ্ছে সিইও থেকে পাওয়া পরিকল্পনা বাস্তবে রূপান্তরিত করা। সিওও এর উপরে কর্পোরেশনের আয় এবং ব্যয়ের অনেক অংশ নির্ভর করে। 

মিডিল ম্যানেজমেন্ট

গতানুগতিক কর্পোরেট স্ট্রাকচারে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও নিম্ন পদস্থ কর্মকর্তার মধ্যবর্তী একটি ম্যানেজমেন্ট থাকে। যেখানে ডিপার্টমেন্ট হেড, ম্যানেজার ও সুপারভাইজার থাকে। এদের কাজ থাকে সাধারণ কর্মীদের সাথে নির্বাহী পরিচালকদের সংযোগ স্থাপন করা।  মিডিল ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বগুলোর মধ্যে থাকে টিম বা ডিপার্টমেন্টের কাজের গতি ঠিক আছে কি নেই এবং কি কি বিষয়ে উন্নতি করা প্রয়োজন। 

পাশাপাশি তারা উপর মহলের সেট করে দেওয়া স্ট্রাটেজি সফলভাবে এক্সিকিউট করতে সহায়তা করে। এগুলোর সাথে সাথে টিম মেম্বারদের ও সাধারণ কর্মীদের স্কিল ডেভেলপমেন্ট ও সার্বিক উন্নতিতে ট্রেনিং সহ সকল ধরনের সহায়তা করে থাকে। প্রতিষ্ঠানে মিডিল ম্যানেজমেন্ট থাকায় কর্পোরেট লেভেলে সিদ্ধান্তগ্রহণ সময় সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। তবে বড় ধরনের কর্পোরেশন গুলো ঠিকভাবে চলতে ও সিইও থেকে সাধারণ কর্মী পর্যন্ত সকল দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করতে এর প্রয়োজন রয়েছে।  

চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (CEO)

ম্যানেজার/ডিপার্টমেন্ট হেড

ডিপার্টমেন্ট হেড বা ম্যানেজার কর্পোরেট স্ট্রাকচারে নির্দিষ্ট কাজের জন্য নিয়োজিত থাকে। ডিভিশনাল ও টিম ভিত্তিক কর্পোরেশন মডেলে এই সিস্টেম সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে সকল ধরনের কর্পোরেট মডেলে ম্যানেজমেন্ট হিসেবে ডিপার্টমেন্ট হেড বা ম্যানেজার থাকা বাধ্যতামূলক। কর্পোরেটে তারা এইচআর, আইটি, মার্কেটিং ও ফাইনান্স সহ সকল সেকশন মেইন্টেইন করে থাকে। 

COO, CMO, মিডিল ম্যানেজমেন্ট ও CFO মূলত প্রতিষ্ঠান কেমন চলছে এবং অগ্রগতি কতদূর তা এদের থেকে রিপোর্ট নেয়। প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে সাধারণ কর্মীদের কাছে এক সেকশন ফ্রন্ট লাইন হিসেবে কাজ করে। ডিপার্টমেন্ট হেড বা ম্যানেজারদের টিম ম্যানেজমেন্ট, বাজেট নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৌশল অবলম্বন সহ পুরো ডিপার্টমেন্টের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব থাকে। 

স্টাফ/এমপ্লয়ি

কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের স্ট্রাকচারের সব থেকে নিম্ন স্থান হচ্ছে স্টাফ বা এমপ্লয়ি। সাধারণ কর্মীদের প্রধান কাজ হচ্ছে তাদের উপর বর্তানো ডেইলি টাস্ক কমপ্লিট করে প্রোডাকশন সচল করা। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সাধারণত প্রধান কাজ কর্মীদের উপরে নির্ভর। তাদের সফলতা ও ব্যর্থতা সব কিছু সরাসরি প্রতিষ্ঠানের উপরে প্রভাব ফেলে। 

বলা হয়ে থাকে “Employees Are The Backbone Of Any Corporation” অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের সফলতা যতটুকু ম্যানেজমেন্টের উপরে নির্ভর করে ঠিক ততটুকু এমপ্লয়ির উপরেও নির্ভর করে। এটা আসলে অস্বীকার করার কিছু না। 

শেষ কথা 

উপরিউক্ত আলোচনায় কর্পোরেট কাঠামো কিভাবে করা হয় ও কর্পোরেট ম্যানেজমেন্ট স্ট্রাকচার কি সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে একজন CEO,CMO থেকে শুরু করে বোর্ড অফ ডিরেক্টর পর্যন্ত সবার দায়িত্ব ও কাজের ধরন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মূলত একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য সঠিক ম্যানেজমেন্ট স্ট্রাকচার অনেক গুরুত্বপূর্ণ।