বিজনেস দুনিয়ায় বহুল আলোচিত প্রশ্ন হচ্ছে উদ্যোক্তা কি তৈরি করা হয় না তারা উদ্যোক্তা হয়েই জন্মগ্রহণ করে? বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে আলাদা আলাদা উত্তর আসলেও কোনটি সঠিক তা নিয়ে আমরা দ্বিধায় থাকি। মূলত কোন সফল উদ্যোক্তার সাথে কথা বললে আপনার মনে হবে তারা জন্মগত ভাবেই উদ্যোক্তা। কিন্তু বাস্তবতা আসলে আলাদা। উদ্যোক্তা সাধারণত তৈরি করা হয়। কেউ জন্মগতভাবে বিজনেস মাইন্ড নিয়ে জন্মায় না। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাকে নিজ উদ্যোগে কিছু করার জন্য প্রস্তুত করে থাকে। নিচে নতুন উদ্যোক্তা কীভাবে সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
নতুন উদ্যোক্তা কিভাবে সৃষ্টি হয়
নতুন উদ্যোক্তা কিভাবে সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
মাইন্ডসেট
নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার সর্বপ্রথম ধাপ হচ্ছে উদ্যোক্তা মাইন্ডসেট। কারণ আপনি যদি মনের দিক থেকে কোন কাজ না করেন তাহলে সেই কাজে কখনোই আপনার মন বসবে না। আর মন না বসলে সেখান থেকে আপনি কখনোই ক্রিয়েটিভ কিছু করতে পারবেন না। উদ্যোক্তা হওয়া আসলে একটি জার্নি।
এই জার্নিতে সফল হতে হলে বিভিন্ন বাধা মোকাবেলা করার পাশাপাশি ঝুঁকি নেওয়ার সাহস থাকতে হবে। ঝুঁকি নিতে না পারলে আমরা কখনোই নতুন কিছু করার সাহস পাবো না। উদ্যোক্তা হতে চাইলে আমাদের নতুন কিছু করতেই হবে। অতএব সঠিক মাইন্ডসেট না থাকলে কখনোই উদ্যোক্তা হওয়ার মতো চ্যালেঞ্জিং উদ্যোগ নেওয়া উচিত নয়। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
চাকরি না করার প্রবণতা
নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার পথে ফুয়েল দেয় চাকরির না করার মনোভাব। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে চাকরি পাওয়া অনেক কঠিন। কোন ভাবে চাকরি পেলেও তার বেতন এত কম হয় যে পরিবার নিয়ে সারভাইভ করা অনেক কঠিন হয়ে পরে। অন্যদিকে দিনে দিনে কর্মসংস্থান যেমন কমে যাচ্ছে তেমনি নতুন করে কর্মসংস্থান তৈরিও হচ্ছে না। যে কারণে তরুণদের মনে উদ্যোক্তা হওয়ার মাইন্ডসেট তৈরি হওয়া শুরু করেছে।
এখন আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় তরুণদের প্রায় বলতে শুনি “চাকরি করবো না, চাকরি দেব”। যার অর্থ তারা উদ্যোক্তা হয়ে আরও বেশি বেশি নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। যে কারণে নতুন নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগ চোখে পড়ছে। অন্যদিকে ভাইরাল মার্কেটিং ব্যবহার করে সহজেই বিপুল পরিমাণ কাস্টমার পাওয়া যাচ্ছে।
বিজনেসের প্রবণতা
বিজনেস করার প্রতি সবার একটা না একটা সময় ঝোঁক তৈরি হয়। সময়ের সাথে সাথে অনেকে সেই ঝোঁক থেকে নিজেকে বের করে নেয়। আবার অনেকে সাময়িক ভাবে বের হয়ে গেলেও পরবর্তীতে আবার ফিরে আসে। এমন অনেককে দেখা যায় তারা একটা সময় স্টাবল চাকরি জীবন থেকে বের হয়ে এসে বিজনেস করা শুরু করে। আবার অনেকে চাকরি জীবন শুরুর পূর্বেই উদ্যোক্তা জীবনে প্রবেশ করে।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এখানে দুই ধরনের মাইন্ডসেট কাজ করে। এখানে এক শ্রেণি ছোট বেলা থেকেই চাকরি করার উদ্দেশ্যে নিজেকে তৈরি করে। অন্যদিকে আরেক শ্রেণি বিজনেস করার দিকে মনোনিবেশ করে থাকে। সাধারণত এই ধরনের মাইন্ডসেট তৈরি হওয়ার পেছনে আমাদের অভিভাবকদের অনেক অবদান রয়েছে। তবে বর্তমানে মানুষের চিন্তা ধারা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অল্প পুঁজি দিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর বিজনেস দার করানো যায় জন্য অনেক তরুণ নতুন করে উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে। মূলত তাদের বিজনেসের প্রতি ভালোবাসা থেকে এই ধরনের চিন্তা ধারার সৃষ্টি হচ্ছে।
শিক্ষা ব্যবস্থা
আমাদের উদ্যোক্তা হওয়ার জার্নিতে শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে যারা বিজনেস স্টাডি বা কমার্সের সাবজেক্ট গুলায় লেখাপড়া করে তাদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এর কারণ তারা উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য কি কি চ্যালেঞ্জ ফেস করতে হয় এবং তা থেকে কীভাবে উত্তরণ করা যায় সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে।
যে কারণে তাদের সাহসিকতা বৃদ্ধি পায় এবং ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা বারে। পাশাপাশি তাদের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পায় এবং উদ্যোক্তা হওয়ার মাইন্ডসেট তৈরি হয়। সর্বোপরি নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।
অর্থনৈতিক উন্নতি
আমাদের এত কঠোর পরিশ্রমের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নতি। আর্থিক ভাবে সচ্ছল হওয়ার জন্য আমরা সকাল সন্ধ্যা কাজ করে থাকি। কিন্তু দেশের অর্থনীতি ও সামাজিকতার কারণে বিপুল পরিমাণ তরুণ নাম মাত্র বেতনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। এদের মধ্যে অনেকেই পরিস্থিতির শিকার হয়ে জীবন নিয়ে অন্যরকম চিন্তা থাকলেও অর্থনৈতিক শিকলে বন্দী থাকে।
তবে বর্তমানে এই সিকল থেকে বের হতে চাইলে এক মাত্র পথ হচ্ছে উদ্যোক্তা হওয়া। কারণ সঠিক ভাবে কোন উদ্যোগ সফল করতে পারলে অর্থনৈতিক উন্নতি যেমন হবে তেমনি সামাজিকভাবেও স্বীকৃতি পাওয়া যাবে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ভাবে উন্নতি করতে গেলে আমাদের আউট অফ দা বক্স চিন্তা করতে হবে। আর সঠিক পথে উন্নতি করতে চাইলে উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা জরুরি।
স্বাধীনতা
নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা কাজ করে। আপনি একজন সফল উদ্যোক্তার সাথে কথা বলে দেখবেন তাদের মধ্যে এই স্বাধীনতা বিষয় কত প্রখরভাবে কাজ করে। একজন মানুষ তখনি চাকরি ছেড়ে বিজনেস করতে চায় যখন তার স্বাধীনতার প্রয়োজন অনেক প্রখর হয়। কারণ উদ্যোক্তা জীবনে যেমন অনেক চাপ ও ঝুঁকি থাকে তেমনি আপনি কাজ করার অবাধ স্বাধীনতা পাবেন। এখানে আপনি চাকরি জীবনের মতো এত পরাধীন থাকবেন না।
যদিও উদ্যোক্তা হিসেবে আপনাকে অনেক বেশি কাজ করতে হবে। তবে আপনি যদি একটি ভালো এবং ট্রাস্ট করার মতো টিম তৈরি করে ফেলতে পারেন তাহলে পরিশ্রম অনেক কমে যাবে। কারণ আপনার কাজ তখন টিমের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। তখন আপনি জেতা খুব দরকারি সেই কাজ বাদে শুধু তদারকি করেই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারবেন। সাধারণত স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায় জন্য নতুন করে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
আত্মসম্মান
আত্মসম্মান বিষয়টা হচ্ছে আপেক্ষিক। যার দৃষ্টিকোণ যেমন তার কাছে আত্মসম্মান তেমন। কিন্তু চাকরি এবং বিজনেস এই দুইটি বিষয়ের মধ্যে চাকরি থেকে বিজনেস করে বেশি সম্মান বৃদ্ধি করা যায়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সম্মান বৃদ্ধি করা যায় জন্য তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কারণ এতে ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি ও কাজের ক্ষেত্রে ইতিবাচক উন্নয়ন হয়ে থাকে। নতুন করে অনেক ছোট ও বড় উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার পেছনে এই টার্ম ইনফ্লুয়েন্স করে থাকে। আমাদের সমাজে একটা বিষয় প্রচলিত আছে যে যার যত টাকা সে তত সম্মানী। যে কারণে চাকরি থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য সবার মধ্যে একটি সফট কর্নার কাজ করে।
প্রযুক্তির উপর ভরসা
এফ-কমার্স বর্তমান সময়ে ব্যাপক প্রচলিত একটি বিজনেস টার্ম। হাজার হাজার তরুণ ফেসবুক প্লাটফর্ম ইউজ করে স্বল্প সময়ে স্টাবল অনলাইন বিজনেস দার করিয়ে ফেলেছে। এই ধরনের অনলাইন বিজনেস গুলো সহজে সেটআপ করা যায় এবং এখানে ফিজিক্যাল কোন অফিস লাগে না জন্য অনেকের মধ্যেই অনলাইন উদ্যোগ নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নতুন করে যারা উদ্যোক্তা হচ্ছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগ অনলাইনে বিজনেস শুরু করছে। ফেসবুক বাদেও ই-কমার্স বিশ্ববাজারের অনেক বড় অংশ জুড়ে রাজত্ব করছে। আমাদের দেশে এই ধরনের অনেক উদ্যোগ সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে। তো বলা যায় নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে প্রযুক্তি ও ডিজিটাল প্লাটফর্ম গুলো অনেক হেল্পফুল।
শেষ কথা
একটি সমাজে তখনি উন্নতি হবে যখন সেখানে ছোট বড় অনেক ধরনের উদ্যোগ প্রতিষ্ঠিত হবে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশের উন্নয়নের জন্য উদ্যোক্তা পর্যায়ে ব্যবসায়িক উদ্যোগ নেওয়া অনেক প্রয়োজন। এখানে যে যে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে তা নতুন উদ্যোক্তা কীভাবে সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিয়েছে।