ট্রেড লাইসেন্স হচ্ছে ব্যাবসা এর আইনি স্বীকৃতি। অর্থাৎ আপনার এই লাইসেন্স থাকা মানে সরকার কর্তৃক আপনাকে ব্যবসা করার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এটি ব্যবহার করে আপনি ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সহজেই আইনি সহায়তা পাবেন। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে সরকার স্থানীয় পর্যায়ে এই লাইসেন্স দেওয়া শুরু করেছে।
ট্রেড লাইসেন্স কি কি?
বাংলাদেশে সাধারণত তিন ধরনের ট্রেড লাইসেন্স যেমন কমার্শিয়াল, প্রফেশনাল ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাইসেন্স হয়ে থাকে। নিচে এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
কমার্শিয়াল ট্রেড লাইসেন্স
কমার্শিয়াল ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয় সাধারণত যে সকল বিজনেস ট্রেডিং, হোলসেলিং ও রিটেইল এর ক্যাটাগরিতে পরে। অর্থাৎ ছোট দোকান যেমন কাপড়ের দোকান, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান, সেলুন, রেস্টুরেন্ট, পাইকারি বিজনেস, গাড়ি বা মোটরসাইকেল ঠিক করার দোকান ইত্যাদি কমার্শিয়াল ট্রেড লাইসেন্সের ভেতরে পরে।
প্রফেশনাল ট্রেড লাইসেন্স
প্রফেশনাল লাইসেন্স দেওয়া হয় যে সকল বিজনেস প্রফেশনাল দ্বারা তৈরি। যেমন ফ্রিল্যান্সার, আইনজীবী, কনসালটেন্ট, হিসাব রক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী সহ যে সকল সার্ভিস নির্ভর বিজনেস রয়েছে তারা এই ক্যাটেগরির ট্রেড লাইসেন্সের ভেতরে পরে।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেড লাইসেন্স
ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাইসেন্স দেওয়া হয় সে সকল বিজনেস কে যেখানে পণ্য তৈরি করা হয়। অর্থাৎ ধরুন আপনার একটি প্যাকেজিং বা বক্স তৈরি করার বিজনেস আছে। এখন আপনি এই বিজনেস লিগ্যাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেড লাইসেন্স করতে হবে।
ট্রেড লাইসেন্স কোন কোন জায়গা থেকে করা যায়?
সাধারণত ট্রেড লাইসেন্স কোথায় থেকে করবেন তা নির্ভর করে আপনার বিজনেস কোথায় থেকে পরিচালিত হচ্ছে। ট্রেড লাইসেন্স আইন ২০০৯ অনুযায়ী আপনি বাংলাদেশে মোট তিন জায়গা থেকে লাইসেন্স নিতে পারবেন। নিচে সে সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত ধারনা দেওয়া হলো।
ইউনিয়ন পরিষদ
বিজনেস লোকেশন যদি ইউনিয়ন পরিষদের আওতায় হয় তাহলে ট্রেড লাইসেন্স করার জন্য পরিষদের তথ্য কেন্দ্রে যেতে হবে। সেখানে ট্রেড লাইসেন্সের ফর্ম সংরহ করতে হবে এবং বিজনেস ধরণ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সাবমিট করতে হবে।
পৌরসভা
আপনি যে স্থানে বিজনেস করছেন তা যদি পৌরসভার মধ্যে পরে তাহলে ট্রেড লাইসেন্স করার জন্য আপনাকে পৌরসভাতে যেতে হবে। এখানেও বিজনেসের ধরণ অনুযায়ী ফর্ম নিয়ে ডকুমেন্ট সাবমিট করতে হবে।
সিটি কর্পোরেশন
বাংলাদেশে বর্তমানে ১২ টি সিটি কর্পোরেশন রয়েছে। আপনার বিজনেস যদি সিটি কর্পোরেশন লোকেশনের মধ্যে পরে তাহলে অবশ্যই সেখানে যোগাযোগ করতে হবে। ফর্ম সংরহ করার পর সাথে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সাবমিট করলে সাধারণত ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে লাইসেন্স পাওয়া যায়।
ট্রেড লাইসেন্স করতে কি কি ডকুমেন্ট প্রয়োজন?
লাইসেন্স করতে কোন ধরনের ডকুমেন্ট প্রয়োজন পরে তা বিজনেসের ধরণ এবং লোকেশনের উপরে নির্ধারিত থাকে। তবে আপনার একক মালিকানা বিজনেস না যৌথ মালিকানা বিজনেস তার উপর নির্ভর করে ডকুমেন্ট পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন হতে পারে। এখানে কিছু কমন ডকুমেন্ট রয়েছে যা ট্রেড লাইসেন্স করতে হলে থাকা একান্ত প্রয়োজন।
- আবেদন পত্র
- ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি
- দুই বা চার কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি
- বিজনেস অ্যাড্রেসের প্রমাণ যেমন ইলেক্ট্রিসিটি বিল, জমির দলিল ইত্যাদি
- অন্য কোন ব্রান্ডের মালিকানাধীন হলে উক্ত ব্রান্ড এর রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট
- TIN সার্টিফিকেট
- বিজনেস মালিকানার ডকুমেন্ট অর্থাৎ যদি বিজনেস যৌথ মালিকানা হয় বা ভারা নেওয়া কোন যায়গায় হয় তাহলে এগ্রিমেন্ট এর ডকুমেন্ট থাকতে হবে।
মূলত বেশীরভাগ বিজনেসের ট্রেড লাইসেন্স করতে গেলে এই সকল ডকুমেন্ট গুলো প্রয়োজন পরে। এর বাইরেও বিজনেসের ধরনের উপর নির্ভর করে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট পরিবর্তন হতে পারে।
ট্রেড লাইসেন্স করতে কত টাকা লাগে?
ট্রেড লাইসেন্স করতে কত টাকা লাগবে তা আসলে নির্ভর করে বিজনেসের ধরনের উপরে। সাধারণত ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভায় লাইসেন্স করতে গেলে খরচ সর্বনিম্ন ২০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। অন্যদিকে সিটি কর্পোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স করতে গেলে বিজনেসের ধরণ অনুয়াই ১৫০০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাগতে পারে। এখানে অবশ্যই আপনার বিজনেস ক্যাটেগরি, ছোট, মাঝারী না বড় ব্যবসা এই সকল প্যারামিটার হিসেব করে লাইসেন্সের ফি পরিশোধ করতে হয়।
ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন না করলে কি হবে?
লাইসেন্স নবায়ন না করলে আপনাকে লাইসেন্সের মূল্য অনুযায়ী মাসিক ১০% হারে জরিমানা দিতে হবে। অর্থাৎ আপনি যদি এক বছর লাইসেন্স নবায়ন না করেন তাহলে আপনার লাইসেন্সের সাথে ১২০% জরিমানা যোগ হবে। এখন ধরুন আপনার নেওয়া ট্রেড লাইসেন্সের ফি ছিল ৩ হাজার টাকা এখন এক বছর লাইসেন্স রিনিউ না করার কারণে পরের বছর আপনাকে ৩০০০+৩৯০০ = ৬৯০০ টাকা পরিশোধ করতে হবে।
ট্রেড লাইসেন্স এর মেয়াদ কত দিন?
ট্রেড লাইসেন্স হচ্ছে একটি নিয়মিত বিষয়। অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকারের আইন অনুযায়ী প্রতি বছর ট্রেড লাইসেন্স আপডেট করে নিতে হবে। এবং আপডেট করার সময় নতুন লাইসেন্স করতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হবে ঠিক সে পরিমাণ ফি দিতে হবে। ফি দেওয়ার জন্য আপনার লাইসেন্সে থাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বারে টাকা জমা দিলেই হবে।
সাধারনত পুরাতন লাইসেন্স এক্সপায়ার হওয়ার ৭ দিনের মধ্যে লাইসেন্স নবায়ন করার আবেদন করতে হয়। সঠিক সময়ে আবেদন করলে এক দিনের মধ্যেই লাইসেন্স নবায়ন হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে পুরাতন ট্রেড লাইসেন্স সহকারে আপনার লোকেশনের আঞ্চলিক কর কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করতে হবে। তারপর প্রয়োজনীয় নিয়ম অনুসরণ করে উক্ত কর্মকর্তা আপনার পুরাতন লাইসেন্স রিনিউ করে দিবে।
ট্রেড লাইসেন্সের সুবিধা
ট্রেড লাইসেন্স থাকলে একটি বিজনেসে নানাবিধ সুবিধা পাওয়া যায়। নিচে তা বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন
মানুষের সাইকোলজি খুব সাধারণ ভাবেই লাইসেন্স প্রাপ্ত বিজনেসকে একটি লাইসেন্স ছাড়া বিজনেস থেকে বেশি বিশ্বাস করবে। কারণ লাইসেন্স আছে বলতে তাকে যে কোন সময় আইনের আওতায় আনা যাবে। অর্থাৎ কোন কারণে বিজনেসের ক্ষেত্রে অবৈধ কিছু করলে লাইসেন্সে দেওয়া তথ্য অনুসারে যোগাযোগ করা যাবে। পাশাপাশি প্রশাসনের দিক দিয়েও সহায়তা পাওয়া যাবে।
সরকারী ইনসেন্টিভ পাওয়ার সুবিধা
লাইসেন্স করা থাকলে সরকারী ভাবে বিভিন্ন খাতে যে ভর্তুকি দেয় তা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ লাইসেন্স প্রাপ্ত বিজনেস সম্পর্কে সরকারের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য থাকে। অন্যদিকে সরকারী ইনসেন্টিভ পেতে হলে ট্রেড লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
লোন পেতে সুবিধা হয়
সাধারণত ব্যাংক থেকে লোন নিতে গেলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। বিশেষ করে অনেক ধরনের ডকুমেন্ট সহ সম্পত্তির বিনিময়ে লোন নিতে হয়। ব্যক্তি পর্যায় লোন নেওয়ার থেকে প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক লোন নেওয়া আরও বেশি ডকুমেন্টের বিষয়। এই ক্ষেত্রে আপনার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের যদি লাইসেন্স থাকে তাহলে লোন পেতে অনেক সুবিধা হবে।
আইনি ঝামেলা থেকে মুক্তি
ট্রেড লাইসেন্স থাকা মানে হচ্ছে বিজনেসের সরকারী এবং আইনগত সুবিধা পাওয়া যায়। এর অর্থ হচ্ছে আপনার বিজনেস লোকাল ল অনুসারে প্রতিষ্ঠিত। যে কারণে আপনি অবৈধ স্থাপনা বা এই জাতীয় সকল ধরনের সরকারী জরিমানা থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন।
মার্কেটিং বা প্রোমোশন করায় কোন বাঁধা নেই
বিজনেস বৃদ্ধি করার জন্য আমরা মার্কেটিং এর শরণাপন্ন হয়ে থাকি। কিন্তু অনেক ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে যারা অ্যাড প্রচার করার জন্য আপনার বিজনেস যে লিগ্যাল তা নিশ্চিত হতে ট্রেড লাইসেন্সের কপি চাইতে পারে। এই ক্ষেত্রে বিপণনের জন্য আপনার ট্রেড লাইসেন্স প্রয়োজন হবে।
বিজনেস বৃদ্ধিতে সহায়ক
ট্রেড লাইসেন্স থাকলে জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ে এবং এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে বিজনেস বৃদ্ধি করতে কোন আইনি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। পাশাপাশি অন্য যায়গায় বিজনেসের জন্য কোন অ্যাসেট নিতে গেলেও লোকাল প্রশাসন থেকে কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না।
শেষ কথা
ট্রেড লাইসেন্স ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে বৈধতা প্রদান করে। সরকারী আইন মতে সকল ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এই লাইসেন্স থাকা জরুরী। অবৈধ জরিমানা এবং উচ্ছেদ থেকে মুক্ত থাকতে এই লাইসেন্স ঢাল হয়ে কাজ করে। এই লেখায় ট্রেড লাইসেন্স কি, কীভাবে করে এবং কোথায় থেকে করা যাবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা দেওয়া হয়েছে।